হামাস-ইজ়রায়েল চলতি সংঘাত কি এ বার গাজ়া ভূখণ্ড ছেড়ে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও ছড়িয়ে পড়তে চলেছে? এমন জল্পনা ছড়িয়ে পড়ার কারণ বৃহস্পতিবার ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের একটি প্যালেস্তিনীয় আশ্রয়শিবিরে আকাশপথে হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলি সেনা।
প্যালেস্তিনীয় প্রশাসনের তরফে দাবি করা হয়েছে যে, এই ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেরই আশঙ্কা, চলতি সংঘাতের তৃতীয় যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠতে চলেছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক— ৭ অক্টোবরের পর প্যালেস্তাইনের যে অঞ্চল মোটের উপর শান্ত ছিল।
দু’জায়গাতেই প্যালেস্তিনীয়দের বাস হলেও নানা দিক থেকে বহু অমিল রয়েছে গাজ়া ভূখণ্ড এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মধ্যে। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী গাজ়া সঙ্কীর্ণ একটি ভূখণ্ড হলেও তুলনায় ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অনেক বেশি চওড়া।
তবে ভূগোলের থেকেও গাজ়া এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অমিল তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। ২০০৭ সাল থেকেই গাজ়ায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব কায়েম করেছে প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র সংগঠন হামাস।
অন্য দিকে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ক্ষমতায় রয়েছে প্যালেস্তিনীয় অথরিটি (পিএ)। ভারত-সহ পশ্চিমের অধিকাংশ দেশই প্যালেস্তিনীয়দের একমাত্র প্রতিনিধি সংগঠন হিসাবে এই পিএ-কেই স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।
খাতায়কলমে প্যালেস্তাইনের প্রেসিডেন্ট হলেন মাহমুদ আব্বাস। আব্বাসের দল ফাতাহ্কে কার্যত একঘরে করে দিয়েই ২০০৭ সালে গাজ়ার দখল নেয় হামাস। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে মোটের উপর নিজেদের প্রভাব ধরে রাখে ফাতাহ্।
তবে এ ক্ষেত্রে ইজ়রায়েলের ভূমিকা নিয়েও বহু চর্চা জারি রয়েছে। কারণ, গাজ়াকে কব্জা করতে না পারলেও দীর্ঘ দিন ধরেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে নিজেদের প্রভাব ধরে রেখেছে তেল আভিভ।
১৯৬৭ সালের আরব-ইজ়রায়েল যুদ্ধে প্যালেস্তিনীয় অধ্যুষিত গাজ়া এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দখল নিয়েছিল ইজ়রায়েল। কিন্তু ঘরে-বাইরে চাপের মুখে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক দখলে রাখলেও গাজ়ার অধিকার ছাড়তে বাধ্য হয় ইজ়রায়েল।
পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের একাংশ মনে করেন, আশির দশকে হামাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইজ়রায়েলের প্যালেস্তাইন নীতিতে বড় বদল আসে।
খানিক ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের মতোই ‘বিভাজন এবং শাসন’ নীতির উপরে ভরসা রাখতে শুরু করে তেল আভিভ। ফাতাহ্ এবং হামাসের মধ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষাতেও তৎপর হয়ে ওঠে ইজ়রায়েল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ক্ষেত্রে ইহুদি-প্রধান দেশটির লক্ষ্য ছিল, ইজ়রায়েল বিরোধী দুই শক্তির ক্ষমতাকেই নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা। যদিও ২০০০ সালের পর ইয়াসের আরাফতের পিএলও এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হতেই, প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পেতে থাকে হামাস।
ইজ়রায়েলের সহায়তায় ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রামাল্লা থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন আব্বাস। তবে গাজ়া ভূখণ্ড থেকে কার্যত মুছে যায় ফাতাহ্।
আব্বাস নিজে ইজ়রায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু ফাতাহ্র একাংশ মনে করছে, বর্তমান সঙ্কটের আবহে ইজ়রায়েলের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত ফাতাহ্র। তেল আভিভের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নতুন করে মূল্যায়ন করার পক্ষপাতী এই অংশটি।
প্যালেস্তাইনের সঙ্গে যে সমস্ত দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তারা রামাল্লার সঙ্গেই যোগাযোগ রেখে চলে। আমেরিকা যেমন গাজ়ার হাসপাতালে হামলার পর আব্বাসের সঙ্গে কথা বলেছে। ওয়াশিংটনের চোখে হামাস ‘সন্ত্রাসবাদী’ গোষ্ঠী।
তবে হামাস কেবল যুদ্ধ নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবেও গাজ়ার বাসিন্দাদের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। তারা চায় লড়াইয়ের মাধ্যমে ইজ়রায়েল রাষ্ট্রের উচ্ছেদ ঘটাতে।
ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকেও ফাতাহ্ এবং ইজ়রায়েলি সেনাকে সরাতে চায় হামাস। ইজ়রায়েলি রকেট হামলার পর অনেকেরই আশঙ্কা যে, এ বার লেবানন এবং গাজ়ার পর তৃতীয় রণভূমি হয়ে উঠতে চলেছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক।
অন্য দিকে, প্যালেস্তিনীয় আবেগের কথা মাথায় রেখেই আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন আব্বাসও। তবে আবেগকে সম্বল করে চলতি সংঘাতের আবহে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক আর গাজ়া কাছাকাছি আসবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।