স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিতে প্রতি বছরই মাথায় রঙিন পাগড়ি বেঁধে হাজির হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রতি বারই পাগড়ির রং বদলায়। কেতা বদলায়। ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসেও বদলেছে। মঙ্গলবার সকালে লাল কেল্লায় মোদী বক্তৃতা করেছেন রংবেরঙের রাজস্থানি বাঁধনি ছাপের পাগড়ি পরে। হঠাৎ রাজস্থানি পাগড়ি কেন? কারণ কি রাজস্থানের আসন্ন ভোট? মোদীর পোশাক নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে তাত্ত্বিক কাটাছেঁড়া।
দেশের পোশাক সচেতন রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদী যে অন্যতম, তা তাঁর সমালোচকেরাও মানবেন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে মোদীর সচেতনতার প্রমাণ পাওয়া যেত। শোনা যায়, এক দিনে দু’জায়গায় বক্তৃতা থাকলে মোদীর গাড়িতে দু’টি আলাদা পোশাক আলাদা জ্যাকেট, প্রয়োজনে আলাদা উড়নিও রাখা হত এক সময়ে।
সেই মোদী দেশের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দেওয়ার পোশাক যে ভেবেচিন্তে বাছবেন, সে ব্যাপারে দ্বিমত থাকার কথা নয়। কারণ, এর আগেও মোদীকে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন দেশে বা রাজ্যে গিয়ে সে দেশের বেশে সাজতে। সে আফ্রিকা হোক বা মেঘালয় কিংবা হিমাচল।
শিরসজ্জা নিয়ে বরাবরই সচেতন মোদী। সব সময় মাথায় টুপি বা পাগড়ি পরেন, তা নয়। তবে সময়-সুযোগ হলে উপলক্ষ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে হ্যাট, সাফারি ক্যাপও পরতে দেখা গিয়েছে। সাধারণতন্ত্র দিবসেও মোদী প্রতি বছরই ভাষণ দিয়েছেন কখনও পাগড়ি, কখনও আবার ঐতিহ্যবাহী টুপি পরে। তবে গত ১০ বছরে স্বাধীনতা দিবসে পাগড়ি ছাড়া অন্য কিছু পরেননি।
২০১৯ সালের নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এটিই ছিল মোদীর শেষ স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতা। আর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দশম স্বাধীনতা দিবস। মঙ্গলবার মোদী পরেছিলেন ভি-গলা কালো জ্যাকেট। সঙ্গে সাদা কুর্তা এবং চুড়িদার। পাগড়িটি ছিল রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী বাঁধনি প্রিন্টের কাপড়ের। মূলত সোনালি হলুদ আর মেরুন রঙের আধিক্য থাকলেও ওই পাগড়ির কাপড়টি নীল, সবুজ, লাল রঙে রাঙানো ছিল। এই ধরনের নানা রঙে রাঙানো কাপড়ও তৈরি হয় রাজস্থানেই।
বছর শেষে বিধানসভা ভোট রাজস্থানে। নভেম্বরে বা তার আগেও হতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধীরা বলতে শুরু করেছেন ১৫ অগস্টের ভাষণের মঞ্চে তাই ইচ্ছে করেই মোদী বেছে নিয়েছেন রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী কাপড়।
বিরোধীরা প্রমাণ দেখিয়ে বলেছেন, শুধু ১৫ অগস্টেই নয়, গত ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসেও মোদী মাথায় পরেছিলেন রাজস্থানের বাঁধনি ছাপের কাপড়ের পাগড়ি। তারও কারণও কি রাজস্থানের ভোট?
উদাহরণ দিতে গত বছর সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন বিরোধীরা। ২০২২ সালে বিধানসভা ভোট ছিল হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। মোদী ২০২২ সালের সাধারণতন্ত্র দিবসের বক্তৃতা দিতে হাজির হয়েছিলেন হিমাচলি টুপি এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের ঐতিহ্যবাহী উড়নি গলায় জড়িয়ে।
উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপি এবং বিজেপি সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় এলেও মোদীর হিমাচলি টুপি অবশ্য শেষ পর্যন্ত ম্যাজিক দেখায়নি। গত বছর বিধানসভা নির্বাচনে হিমাচল প্রদেশে ঘাঁটি গাড়তে পারেনি পদ্ম।
২০২৩ সালেও তেমনই বিধানসভা নির্বাচন ছিল কর্নাটকে। যা হয়ে গিয়েছে। বাকি আছে রাজস্থানের নির্বাচন। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকা কর্নাটক নিয়ে বোধ হয় খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না মোদী। বিরোধীরা বলছেন, আসলে মোদীর লক্ষ্য কংগ্রেসে শাসনে থাকা রাজস্থান। তাই সাধারণতন্ত্র দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস— দু’দিনই পোশাকে রাজস্থানকে প্রাধান্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু সত্যিই কি ভোট দেখে পোশাক বাছেন প্রধানমন্ত্রী? গত দশ বছরের স্বাধীনতা দিবসে কবে কোন পোশাক পরেছেন তিনি?
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে ২০২২ সালে মোদী পরেছিলেন সাদার উপর গেরুয়া এবং সবুজ রঙের আঁচড় দেওয়া সাফা বা পাগড়ি। কোমর ছাড়িয়ে দুলছিল পাগড়ির লেজ। গায়ে ছিল গাঢ় আকাশি বন্ধগলা এবং সাদা চুড়িদার কুর্তা।
২০২১ সালে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর ঘোষণা করেছিলেন মোদী, সে বছরও গাঢ় আকাশি বন্ধগলা জ্যাকেট ছিল মোদীর পরনে। সঙ্গে সরু তাঁতের পাড়ের উড়নি। বাংলায় বিধানসভা ভোটে অবশ্য হেরেছিল বিজেপি।
সে বার পাগড়ির রং ছিল আলাদা, জাফরানি পাগড়িতে ছিল ক্রিম এবং গাঢ় বাদামি রঙের লেহরিয়া বাঁধনি ছাপ। সে-ও ছিল রাজস্থানেরই স্টাইল। যদিও সে বছর রাজস্থানে কোনও ভোট ছিল না।
২০২০ সাল ছিল কোভিডের বছর। সে বছর স্বাধীনতা দিবসে মোদী বেছে নিয়েছিলেন ক্রিম রঙা কুর্তা। মাথায় গেরুয়া আর ক্রিম রঙের ডাই করা কাপড়ের পাগড়ি। এই ডাই করা কাপড়ও রাজস্থানেরই ঐতিহ্য। তবে এর সঙ্গে গলায় গেরুয়া পাড় সাদা উড়নি নিয়েছিলেন মোদী। কোভিডের সময় ওই উড়নি দিয়েই নাক এবং মুখ ঢাকতেন তিনি।
২০১৯ সালের ১৫ অগস্ট মোদী লাল কেল্লায় এসেছিলেন হলুদ, লাল, সবুজের লেহরিয়া কাপড়ের পাগড়িতে। এই ধরনের কাপড় মূলত দেখা যায় রাজস্থানে। যদিও গুজরাতেও এই কাপড় তৈরি করা হয়।
২০১৮ সালে লাল কেল্লায় মোদী পরেছিলেন গাঢ় গেরুয়া এবং লাল রঙের পাগড়ি। সেই পাগড়িও ছিল রাজস্থানি বাঁধনি কাপড়ের।
২০১৭ সালে মোদীর পাগড়িতে ছিল উজ্জ্বল লাল-হলুদ রঙের বৈচিত্র। হাফ হাতা মোদী কুর্তার রং ছিল ফিকে হলুদ। তার উপর রূপোলি সুতোর চৌখুপি। এ-ও রাজস্থান-গুজরাতের টাই অ্যান্ড ডাই কাপড়ের।
২০১৬ সালে হাফহাতা সাদা কুর্তা-পাজামার সঙ্গে গেরুয়া, হলুদ, লাল এবং গোলাপি রঙের ডাই করা পাগড়ি পরেছিলেন মোদী।
২০১৫ সাল ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীর দ্বিতীয় বছর। ঘিয়ে রঙের কুর্তা এবং জ্যাকেটের সঙ্গে রং-বেরঙের রেখা টানা পাগড়ি বেছে নিয়েছিলেন মোদী।
২০১৪ ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসাবে লাল কেল্লায় মোদীর প্রথম ভাষণ, সে বারও রাজস্থানের যোধপুরী প্রিন্টের উজ্জ্বল লাল-সবুজ পাগড়ি পরেছিলেন মোদী। সঙ্গে অফ হোয়াইট কুর্তা।
সুতরাং রাজস্থানে ভোট হোক বা না হোক, গত দশ বছরের মোদীর পাগড়ির কাপড় বাছাইয়ে স্পষ্ট রাজস্থান বা গুজরাতের কাপড়ের প্রতি আলাদা টান রয়েছে মোদীর। বেশ বদলে তিনি প্রচার করার চেষ্টা করেননি এমন নয়। তবে রাজস্থানের কাপড় শুধু বিধানসভা ভোটের জন্য বেছে নিয়েছেন তা-ও নয়। আসলে মোদী চান স্বাধীনতা দিবসের মতো বড় মঞ্চে উজ্জ্বল হোক তাঁর উপস্থিতি। হয়তো তাই রাজস্থানের উজ্জ্বল রঙের কাপড় বার বার বেছেন নিয়েছেন তিনি।