প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আরও কাছাকাছি এল ভারত ও ফ্রান্স। আর তাই নয়াদিল্লির থেকে হাতিয়ার কিনতে চাইছে প্যারিস। শেষ পর্যন্ত এই চুক্তিতে সিলমোহর পড়লে নেপোলিয়ানের দেশে কয়েকশো কোটি টাকার অস্ত্র পাঠাবে ভারত। যার প্রভাবে দেশের অর্থনীতি যে চাঙ্গা হবে, তা বলাই বাহুল্য।
সূত্রের খবর, ভারতের থেকে ‘পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার সিস্টেম’ কিনতে আগ্রহী ফ্রান্স। সেনা পর্যায়ে এই নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। তবে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সরকারি ভাবে অবশ্য কিছু জানায়নি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা ‘এএনআই’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই ইস্যুতে মুখ খোলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ আধিকারিক। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার ওই ফৌজি অফিসারের নাম স্টিফেন রিচৌ। সাক্ষাৎকারে তিনিই প্রথম পিনাকার প্রসঙ্গ তোলেন।
এএনআইকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিচৌ বলেছেন, ‘‘আমাদের বড় সংখ্যায় মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারের (এমবিআরএল) প্রয়োজন রয়েছে। ভারতের পিনাকা সেই জায়গাটা নিতেই পারে। এটা যথেষ্ট উন্নত ও ধ্বংসাত্মক একটা হাতিয়ার।’’
গত দু’বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে রাশিয়া। এটির সাহায্যেই রাজধানী কিভ-সহ পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির একাধিক শহরকে নিশানা করে মস্কোর সেনাবাহিনী। রুশ এমবিআরএল থেকে ছোড়া রকেট ইউক্রেনের ছবির মতো সাজানো একের পর এক এলাকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
সূত্রের খবর, মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারের এই কার্যকারিতা চাক্ষুষ করার পরই তা বাহিনীতে নিয়ে আসার ব্যাপারে উৎসাহী হয় ফরাসি ফৌজ। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিচৌ জানিয়েছেন, এই হাতিয়ার বিক্রির ব্যাপারে অন্য অনেক দেশ ইতিমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে।
‘‘পিনাকার মতো এমবিআরএল আরও বেশ কয়েকটি দেশ আমাদের বিক্রি করতে চায়। আমরা সমস্ত সিস্টেমগুলি খতিয়ে দেখছি। তবে পিনাকা বেশ উন্নত একটি হাতিয়ার। এটা বাহিনীতে শামিল করার জন্য আমরা যথেষ্ট আগ্রহী।’’ এএনআইয়ের সাক্ষাৎকারে বলেছেন ব্রিগেডিয়ার রিচৌ।
চলতি বছরের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নয়াদিল্লি এসেছিলেন এই ফরাসি সেনা অফিসার। তাঁর দাবি, ‘‘দুই দেশের বাহিনীর সম্পর্ক এখন আর শুধুমাত্র ব্যবসায়িক জায়গায় আটকে নেই। একটি অভিন্ন ভবিষ্যৎ কর্মসূচিকে মাথায় রেখে এগিয়ে চলেছি আমরা।’’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিচৌ ভারত সফরে আসার আগে ফ্রান্সে যান দেশের ‘চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ’ (সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহান। সূত্রের খবর, সেখানে পিনাকা বিক্রির ব্যাপারে প্যারিসের সেনা বিভাগের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। যা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে ফ্রান্স চেষ্টা চালিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার সিস্টেমের নকশা তৈরি করেছে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘ডিআরডিও’ (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন)। এই এমবিআরএল থেকে ৭৫ কিলোমিটার পাল্লার রকেট ছোড়া যায়। মাত্র ৪৪ সেকেন্ডে ১২টি রকেট ছুড়তে পারে পিনাকা।
পুরাণ মতে দেবাদিদেব শিবের ধনুকের নাম ‘পিনাক’। সেখান থেকেই এই হাতিয়ারের নামকরণ করা হয়েছে। পিনাকা নির্মাণকারীর তালিকায় নাম রয়েছে একাধিক সংস্থার। যার মধ্যে সোলার ইন্ডাস্ট্রিজ, লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো, টাটা গ্রুপ ও অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড উল্লেখযোগ্য। ট্রাকে করে সহজেই এগুলিকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যায়।
এর আগে ভারত থেকে পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার কিনেছে মধ্য এশিয়ার দেশ আর্মেনিয়া। প্রতিবেশী আজারবাইজানের সঙ্গে শত্রুতা থাকার কারণেই হাতিয়ারটি আমদানি করে তারা। ২০২০ সালে নাগোরনো কারাবাখকে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দিন ধরে চলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। যাতে হার স্বীকার করতে হয় আর্মেনিয়াকে।
আর্মেনিয়ার পাশাপাশি অন্য বেশ কিছু দেশও পিনাকা কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। যদিও কারও সঙ্গেই চূড়ান্ত প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়নি নয়াদিল্লির। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, শেষ পর্যন্ত ফরাসি সেনায় পিনাকা শামিল হলে এর চাহিদা যে বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
আমেরিকার পর ভারতীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারী দেশ হল ফ্রান্স। এ বছরের গোড়ার দিকে ভারত সফরে আসেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। ভারতের সঙ্গে যৌথ ভাবে হেলিকপ্টার এবং ডুবোজাহাজ নির্মাণের বিষয়ে প্রশাসনিক জটিলতা কাটানোর ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন তিনি।
১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে পিনাকা ব্যবহার করেছিল ভারতীয় সেনা। পাক সেনার বাঙ্কার ওড়াতে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এই হতিয়ার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লড়াইয়ে যথেষ্ট ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করে পিনাকা।
ভারতের এই এমবিআরএলের মোট দু’টি প্রজাতি রয়েছে। সেগুলি হল মার্ক-১ এবং মার্ক-২। এর মধ্যে পিনাকা মার্ক ২-এর পাল্লা সবচেয়ে বেশি। ৯০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানতে পারে এই হাতিয়ার। ফরাসি সেনাবাহিনী কোন ধরনের পিনাকা ব্যবহার করতে ইচ্ছুক, তা জানা যায়নি।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স সফরে যান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। তিনি প্যারিসে পা রাখার মুখে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে ‘নেপোলিয়নের দেশ।’ সেখানে হাতিয়ার বিক্রির পাশাপাশি ১০০ শতাংশ প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে প্যারিস।
সূত্রের খবর, চলতি বছরেই নয়াদিল্লির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলতে চাইছে ফরাসি প্রশাসন। যা চূড়ান্ত রূপ পেলে তিন ধরনের হাতিয়ার পাবে ভারতীয় ফৌজ। সেগুলি হল, পরমাণু ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন), জলের নীচের ড্রোন এবং যুদ্ধবিমানের ১১০ কিলো নিউটন থ্রাস্টের ইঞ্জিন।