ঘরবাড়ি বিক্রি, ধারদেনা করে পুত্রকে চিনে পাঠিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় পুত্র বলে গিয়েছিল, “বাবা চিন্তা কোরো না। ডাক্তার হয়ে আমি সব দেনা মিটিয়ে দেব। নতুন বাড়ি বানাব। নতুন আসবাব নিয়ে আসব ঘরে।”
কিন্তু তার আগেই সব ওলটপালট হয়ে গিয়েছে সৈয়দ আব্দুল হুসেন শাদলীর জীবনে। পুত্রের ডাক্তার হয়ে ফেরার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নয়, এখন শুধু পুত্রের দেহ পেতে হাপিত্যেশ করছেন তিনি।
২৫ লক্ষ টাকা দিতে পারলে তবেই পুত্রের দেহ ফেরত পাবেন। চিনের হাসপাতাল থেকে তাঁকে এমনটাই জানানো হয়েছে বলে দৈনিক ভাস্কর-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন শাদলী।
চিনে ডাক্তারি পড়ার খরচ কম। তাই পুত্র শেখ আবদুল্লাকে সেখানে এমবিবিএস পড়তে পাঠিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর পুদুকোট্টাইয়ের বাসিন্দা শাদলী। কিকিহার মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিলেন আবদুল্লা।
কোভিডের বাড়বাড়ন্তে চিন থেকে বছর দুয়েক আগে বাড়িতে চলে এসেছিলেন আবদুল্লা। অনলাইনে পড়াশোনা চালাচ্ছিলেন তিনি।
শাদলী বলেন, “ডিসেম্বরে ইউনিভার্সিটি থেকে ফোন এসেছিল। পুত্রকে বলেছিল যে, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আপনার কোর্স শেষ হয়ে গিয়েছে। ইন্টার্ন হিসাবে যোগ দিতে হবে।”
গত ১১ ডিসেম্বর চেন্নাই বিমানবন্দর থেকে চিনের উদ্দেশে রওনা দেন আবদুল্লা। বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে তিনি বাবাকে বলেছিলেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না। আমাদের সব দুঃখ শেষ হয়ে যাবে। ভাইকেও আমি দেখাশোনা করব।”
শাদলী জানান, চিনে পৌঁছতেই আবদুল্লাকে এক সপ্তাহ নিভৃতবাসে থাকতে হয়েছিল। নিভৃতবাস থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৫ ঘণ্টা সফর করে ইউনিভার্সিটি পৌঁছয় পুত্র। সেখানেও তাঁকে নিভৃতবাসে থাকতে হয়। তার পর হস্টেলে যান আবদুল্লা।
শাদলী বলেন, “হস্টেলে পৌঁছে দু’দিন কথা হয়েছিল আবদুল্লার সঙ্গে। তৃতীয় দিন ফোন করে মাকে জানায়, বমি হচ্ছে। তখন ওর মা বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলে।”
শাদলীর অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুত্রকে ইন্টারনেট ঘেঁটে ওষুধের নাম জানাতে বলেন। তার পর তাঁরা আবদুল্লাকে ওষুধ দেন। সেই ওষুধ খাওয়ার পর আবদুল্লার অবস্থা আরও বিগড়ে যায়। দু’দিন ধরে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকার পর আবদুল্লার রুমমেট বাড়িতে ফোন করে। ভিডিয়ো কলে আবদুল্লাকে দেখায় সে। আবদুল্লা বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল।
শাদলী বলেন, “পুত্রের এই অবস্থা দেখে ওখানকার ভারতীয় ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওঁরা ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে আবদুল্লাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। হাসপাতাল থেকে পুত্রের পাসপোর্ট এবং যাবতীয় নথি নিয়ে নেওয়া হয়। আমাকে দিয়ে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি জায়গায় সই করিয়ে নেওয়া হয়।”
দিন দুয়েক বাদেই শাদলীর কাছে হাসপাতাল থেকে ফোন আসে। তাঁকে বলা হয় ৬ লক্ষ টাকা দিতে হবে। অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে আবদুল্লাকে। কোনও রকমে হংকংয়ে এক পরিচিতের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৬ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করেন শাদলী। তার পর তিন দিন আর কোনও খোঁজ পাননি পুত্রের। এমনটাই দাবি করেছেন শাদলী।
তাঁর কথায়, “এক দিন হঠাৎ ফোন এল। আমাকে বলা হল পুত্রের যকৃত নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসার জন্য ২৫ লক্ষ টাকা লাগবে। কিন্তু এত টাকা পাব কোথায়? ধারদেনায় ডুবে রয়েছি, ঘরবাড়ি বিক্রি করে পুত্রকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছি। ওদের বলেছিলাম, আমরা গরিব। এত টাকা কী ভাবে জোগাড় করব? পুত্রের যে আন্তর্জাতিক বিমা রয়েছে সেখান থেকে টাকা নিতে বলেছিলাম। তাতে রাজি হয়নি।”
শাদলী জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেন। আকুতি করেন তাঁদের কাছে। কিন্তু লাভ হয়নি। এর পর ১ জানুয়ারি তাঁদের কাছে ফোন আসে আবদুল্লার মৃত্যু হয়েছে।
এ কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। কী ভাবে মৃত্যু, কেন মৃত্যু কোনও কিছু জানানো হয়নি বলে অভিযোগ শাদলীর। তাঁর কথায়, “আমাদের শুধু বলা হল, ২৫ লক্ষ টাকা না দিলে পুত্রের দেহ দেওয়া যাবে না।”
পুত্রের দেহ কী ভাবে পাবেন, কোথায় পাবেন এত টাকা তা নিয়েই ভেবে অস্থির সন্তান হারানো এক পিতা।