স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে। প্রতি বছরের মতো মুম্বইয়ের বাসিন্দা পৌলোমী বেড়াতে গিয়েছেন হায়দরাবাদে কাকার বাড়ি। তিন তলা বাড়ির বারান্দায় বোনেদের সঙ্গে মাছ ধরার ভঙ্গিতে খেলছিল ছোট্ট পৌলোমী। আচমকা বিপত্তি। খেলতে খেলতে বারান্দায় টাঙানো লোহার রড পড়ল পৌলোমীর হাতে। তার পর ওই অবস্থায় সেটি পড়ল পাশ দিয়ে যাওয়া ১১,০০০ ভোল্টের ইলেকট্রিক তারে!
এক বার শুধু যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া। তার পর আর তার কিছু মনে নেই। জ্ঞান যখন ফিরল ছোট্ট মেয়েটি দেখল তার ডান হাতটাই নেই!
১১ হাজার ভোল্টের শক খেয়ে মূর্ছা যাওয়া মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় কেউ ভাবতে পারেননি যে তাকে বাঁচানো যাবে। শরীরের একাধিক জায়গায় চোট। দগদগে পোড়া প্রায় সারা শরীর। ওই অবস্থায় কাছের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পৌলোমীকে।
হায়দরাবাদে কাকার বাড়ি থেকে যখন পৌলোমীর বাবা-মায়ের কাছে খবর গেল, তাঁরা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। বিকেলের ফ্লাইটে মুম্বই থেকে হায়দরাবাদে চলে যান পৌলোমীর বাবা ভদ্রেশ পটেল। হাসপাতালে গিয়ে শোনেন তাঁর মেয়েকে বাঁচানো কার্যত অসম্ভব।
সে দিনের কথা মনে পৌলোমী বলেন, ‘‘আমি যে বেঁচে ফিরব, সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল ডাক্তারবাবুদের কাছেও। কারণ, এই রকম ইলেকট্রিক শক খেয়ে কেউ সাধারণ বাঁচেন না। ঘটনাস্থলেই মারা যান।’’
পৌলোমী বলেন, ‘‘আমার শরীরের ৭৫-৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের আইসিইউ-তে সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ কাটে। প্রায় এক সপ্তাহ বার্নস ওয়ার্ডে রাখা হয়।’’
এর মধ্যে ডান হাতে গ্যাংগ্রিন শুরু হয়ে যায় পৌলোমীর। কেটে বাদ দেওয়া হয় ছোট্ট পৌলোমীর ডান হাত। মেয়েকে বাঁচাতে মরিয়া বাবা তাঁকে মুম্বইয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। বাঁ পায়ে কোনও চামড়া নেই, ডান হাত পচনশীল। ওই অবস্থায় পৌলোমীকে ভর্তি করানো হয় মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে।
এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে হায়দরাবাদ থেকে মুম্বইয়ে আনা হয় পৌলোমীকে। তার পর আট মাসে চারটি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় ১২ বছরের মেয়েটির। শরীরে একের পর এক সার্জারি। এ ভাবে ৪৫টি সার্জারি হয় পৌলোমীর সারা শরীরে।
পৌলোমী জানান, সেদিন জ্ঞান ফেরার পর মাকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলেন। তাঁর একটা হাত নেই, এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল।
বাড়ি এসেও প্রায় ঘরে শুয়ে দিন কাটত পৌলোমীর। তার পর আত্মীয়-স্বজন তাদের দেখতে এসে করুণার দৃষ্টিতে তাকাতেন। পৌলোমীর নিজের কথায়, ‘‘সব সময় ওরা বাবা-মাকে বিব্রত করত।’’ মেয়ের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আসা বন্ধ করে দেন বাবা।
আস্তে আস্তে একটু সুস্থ হন পৌলোমী। স্কুলে একটা বছর যাওয়া হয়নি। তবে স্কুলে ফিরতে শিক্ষকদের ভীষণ কাছের করে পেয়েছিলেন পৌলোমী। পরের বছর এক জন ‘রাইটার’-এর সাহায্য নিয়ে বার্ষিক পরীক্ষা দেন। বেশ ভাল নম্বরই পেয়েছিলেন।
ওই বছরই প্রস্থেটিক হাত হল পৌলোমীর। কিন্তু সেই হাতের ওজন এতটা ভারী যে তাকে নিয়ে হাঁটাচলা হয়ে উঠল কষ্টের। তবু আস্তে আস্তে অভ্যেস করলেন। ওই হাত দিয়েই শুরু করেন লেখার চেষ্টা। প্রথম প্রথম দীর্ঘ চিঠি লিখতেন পৌলোমী। খুব কষ্ট হত। তবু করতেন। এ ভাবে একটা বই লিখে ফেলেন তিনি।
অনেকে করুণার চোখে দেখেছে। স্কুল-কলেজে তেমন বন্ধুবান্ধবও হয়নি। সবাই কেমন এড়িয়ে যেতেন। এ সবের মধ্যে শেষ করেছেন এমবিএ-এর পড়াশোনা। কিন্তু একটি ছেলে ছোট থেকে তাঁর হাত ছাড়েননি। সেই সন্দীপ জটওয়ানিকে বিয়ে করেন পৌলোমী।
বরকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই ঝিকমিক করে ওঠে তাঁর মুখ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রায় চোদ্দ বছরের চেনা সন্দীপ। স্কুলের গণ্ডি সদ্য পার করেছি। সেই সময়ে ওর সঙ্গে আলাপ। ওকে কোনও দিন জিজ্ঞেস করতে শুনিনি আমার কী হয়েছিল, কী বৃত্তান্ত। সবই ও জানত বন্ধুদের কাছ থেকে। তবু সব সময় আমার পাশে থেকেছে। আসলে আমি কী চাই, না চাই, ভীষণ অদ্ভুত ভাবে ও বুঝে যায়।’’
অল্প বয়সে হাত হারানো, শরীরে একাধিক সার্জারির পরও শুধু ইচ্ছেশক্তির উপর ভর করে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন পৌলোমী। এখন তিনি লেখেন, গাড়ি চালান, এমনকি, স্কাইডাইভেও চলে যান মাঝেসাঝে। পারিবারিক ব্যবসা সামলান একা।
পৌলোমীর কথায়, আমি জীবনের দু’দিক দেখে ফেলেছি। একটা, সক্ষম অবস্থায় মানুষ কেমন থাকে। অন্যটা, ঠিক উল্টো। শুধু বেঁচে থাকা। আসলে জীবনে প্রতি মুহূর্তে বাধা আসে। কিন্তু সেই বাধা টপকানোতেই বেঁচে থাকার আনন্দ মেলে।’’