শুক্রবার ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে সাতটা। আচমকাই নাকতলায় শিল্পমন্ত্রী তথা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে হানা দেয় ইডির দল। এর পর সময় যত গড়িয়েছে, ততই নাটকীয় মোড় নিয়েছে ঘটনাপ্রবাহ। রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। কিন্তু জেরা থামায়নি ইডি। শনিবার সকাল দশটা নাগাদ গ্রেফতার করা হয় পার্থকে। সূত্রের খবর, প্রায় একই সময় আটক করা হয় অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কেও। শুক্রবার সকাল থেকে ইডির জেরা-পর্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে মোড় নিয়েছে, তারই এক ঝলক রইল এখানে।
সূত্রের খবর, শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ নাকতলায় পার্থর বাড়িতে যায় ইডির সাত থেকে আট জনের দল। সঙ্গে দেখা যায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। এসএসসি মামলায় ইডির অভিযান বলে খবর ছড়ায়। উল্লেখ্য, প্রথম বার এই মামলায় অভিযানে নামতে দেখা গেল ইডিকে। এর আগে এই মামলায় সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন পার্থ।
পার্থর বাড়িতে ইডির হানা ঘিরে যখন শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজ্য জুড়ে, সে সময় প্রকাশ্যে এল আরও এক চমকে দেওয়ার মতো তথ্য। শুধু পার্থর বাড়িতে নয়, রাজ্যের আরও ১২ জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছেন ইডির আধিকারিকরা। তালিকায় রয়েছেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীও।
আনন্দবাজার অনলাইনকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী জানান, তাঁর মেখলিগঞ্জের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে ইডি। তিনি ২১ জুলাইয়ের সভার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। তাই বর্তমানে এ শহরেই রয়েছেন। ইডির হানা প্রসঙ্গে কটাক্ষের সুরে পরেশ বলেন, ‘‘বাড়িতে থাকলে মুড়ি খাওয়াতাম।’’ উল্লেখ্য, ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চে ইডি-সিবিআইয়ের ‘অপব্যবহার’ প্রসঙ্গে কেন্দ্রকে বিঁধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, বাড়িতে সিবিআই-ইডি এলে মুড়ি খাওয়াবেন।
ঘড়ির কাঁটা যত ঘুরেছে, ততই ইডির অভিযান নিয়ে একের পর এক তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। পার্থ, পরেশের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্যের বাড়িতেও হানা দিয়েছে ইডি। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, পর্ষদ সচিব রত্না চক্রবর্তী বাগচী, এসএসসির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিন্হার বাড়িতেও অভিযান চালান তদন্তকারীরা।
তবে ইডির অভিযানে প্রথম থেকেই নজরে ছিল পার্থর নাকতলার বাড়িতে। রাজ্যের মন্ত্রীর বাড়িতে ইডির অভিযান নিয়ে শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক চাপানউতর। বিজেপিকে নিশানা করতে আসরে নামে তৃণমূল। পাল্টা আক্রমণ শানায় বিজেপিও।
কলকাতার মেয়র তথা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘‘২১ জুলাই আমরা কেন্দ্রকে আক্রমণ করেছি, সে কারণেই বেইজ্জত করতে প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে বিজেপি।’’
তৃণমূলকে পাল্টা বিঁধে বিজেপি সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘নারদা-সারদা থেকে দেখছি, বাংলায় যে ভাবে সীমাহীন দুর্নীতি চলছে, তাতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও আমরা লজ্জিত। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সে ভাবেই এগোচ্ছে তদন্ত।’’
ইডির অভিযানের মধ্যেই পার্থর বাড়িতে যান তাঁর আইনজীবী অনিন্দ্যকিশোর রাউত। তবে নাকতলায় পার্থর বাড়িতে ইডির আধিকারিকরা ঠিক কী করছেন, কী নিয়ে জেরা চলছে, সে ব্যাপারে জানা যায়নি। এ নিয়ে পার্থর আইনজীবীকে কয়েক বার বাড়ির বাইরে বেরোতে দেখা গেলেও এ নিয়ে মুখ খোলেননি।
শুক্রবার দুপুরে পার্থর অসুস্থতার খবর ছড়ায়। শোনা যায়, ইডির জেরা চলাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন পার্থ। চিকিৎসকদের ডেকে পাঠান তাঁর আইনজীবী। চিকিৎসকরা তাঁর ইসিজি করার পরামর্শ দেন বলে সূত্র মারফত জানা যায়।
পার্থর বাড়ি থেকে তিন চিকিৎসককে বেরোতে দেখা যায় শুক্রবার বিকেলে। তবে পার্থর শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে তাঁরা কেউই মুখ খোলেননি।
সকাল গড়িয়ে বিকেল, তখনও পার্থর বাড়ি-সহ মোট ১৩ জায়গায় ইডির তল্লাশি অভিযান জারি থাকে। পার্থর বাড়িতে দেখা যায় নেতাজিনগর থানার পুলিশকে।
সন্ধ্যার পরই এই ঘটনাপ্রবাহ একেবারে নাটকীয় মোড় নেয়। পার্থ ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের টালিগঞ্জের অভিজাত আবাসনে হানা দেয় ইডি। সূত্রের দাবি, জেরা করার সময়ই অর্পিতার ব্যাপারে জানতে পারেন তদন্তকারীরা।
এর পরই অর্পিতার আবাসনে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ হয় তদন্তকারীরা। সূত্রের খবর, ফ্ল্যাটের একটি ঘরের আলমারি থেকে নগদ ২০ কোটি টাকা পাওয়া যায়। পরে এই খবর টুইট করে জানায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। এক সঙ্গে এত টাকা উদ্ধার ঘিরে হইচই পড়ে যায় রাজ্য রাজনীতিতে।
ইডির দাবি, অর্পিতা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ। তদন্তকারীদের আরও দাবি, ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতার বাড়ি থেকে ২০টি মোবাইল ফোনও উদ্ধার হয়েছে। পাওয়া গিয়েছে সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রাও।
তখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। অর্পিতার ফ্ল্যাটে টাকা গোনার কাজ শুরু করেন তদন্তকারীরা। ব্যাঙ্ক থেকে আনা হয় টাকা গোনার যন্ত্র।
এই প্রেক্ষাপটে শুক্রবার রাত ১০টা ৬ মিনিট নাগাদ তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ টুইট করে জানান, ইডির অভিযানে যে টাকা উদ্ধার হয়েছে, তার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই।
এক দিকে যখন অর্পিতার ফ্ল্যাটে টাকা গোনার কাজ চলছে, তখন পার্থর বাড়ির সামনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে। শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ পার্থের বাড়িতে আরও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। আরও এক জন ইডি আধিকারিককে পার্থর বাড়িতে ঢুকতে দেখা যায়।
ইডি সূত্রে জানা যায়, পার্থর বাড়ি থেকে বেশ কিছু নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আইনজীবীদের সামনে বসে সেই সব নথিতে সই করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী।
মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, ইডির জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে নৈশভোজ সারেননি পার্থ। খেয়েছেন শুধু চা-বিস্কুট।
রাত ২টো ২০ মিনিট নাগাদ পার্থর বাড়ির সামনে কলকাতা পুলিশের বিশাল বাহিনীকে জড়ো হতে দেখা যায়। মন্ত্রীর আইনজীবী অনিন্দ্য রাউত বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে কথা বলেন পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে।
এর পর রাতভর পার্থর বাড়িতে থাকেন ইডির আধিকারিকরা। শনিবার ভোরেও পার্থর বাড়ি থেকে বেরোতে দেখা যায়নি ইডির আধিকারিকদের। বাড়ির ভিতরে ঠিক কী হচ্ছে, তা জানা যায়নি।
শনিবার সকালে জানা যায়, অর্পিতার বাড়ি থেকে মোট ২১ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ৫০ লক্ষ টাকার গয়না পাওয়া গিয়েছে। বেলঘরিয়ার রথতলা এলাকায় একটি অভিজাত আবাসনে আরও দু’টি ফ্ল্যাট রয়েছে অর্পিতার।
শনিবার সকাল ৭টা ৩০। ২৪ ঘণ্টা পার হলেও পার্থর বাড়ি থেকে ইডির আধিকারিকদের বেরোতে দেখা গেল না।
শনিবার সকাল ৭টা ৫৭ মিনিট নাগাদ টানা জিজ্ঞাসাবাদের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়েন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। শনিবার সকালে তিনি অসুস্থবোধ করতে থাকেন বলে দাবি করেন তাঁর আইনজীবী অনিন্দ্যকিশোর রাউত। সকালেই চিকিৎসকদের খবর দেওয়া হয়। সকাল ৮টা নাগাদ নাকতলায় মন্ত্রীর বাড়িতে ঢুকতে দেখা যায় এক চিকিৎসককে। পরে জানা যায়, দু’জন চিকিৎসক মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে তাঁর বাড়িতে এসেছেন।
শনিবার সকাল ৯টা ৫০ মিনিট নাগাদ গ্রেফতার করা হয় পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সিজিও কমপ্লেক্সে।
এর মধ্যেই খবর পাওয়া যায়, ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতাকেও আটক করা হয়েছে। তাঁদের মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না ইডির একটি সূত্র।