সবে কেটেছে ২১ জুলাইয়ের রাত। বড় সভা সামাল দিয়ে তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীরা কিঞ্চিৎ বিশ্রামের মেজাজে। সেই আপাত অলস সকালেই বোমার মতো এসে পড়েছিল খবরটা। সে-ও ছিল এই শনিবারের মতোই এক ২২ জুলাই। ঠিক এক বছর আগে যে দিন রাজ্যের শাসকদলের তৎকালীন মহাসচিব তথা রাজ্যের তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডি।
তখনও অবশ্য অনেকেই জানতেন না, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেফতার হতে চলেছেন তৃণমূলের সেই সময়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী পার্থ। বা তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ বান্ধবী’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হতে চলেছে টাকার পাহাড়। যার চূড়ায় চূড়ায় পাওয়া যাবে শিক্ষা দফতরের নাম ছাপানো খাম, উচ্চ শিক্ষা দফতর সংক্রান্ত সরকারি নথি, স্কুল শিক্ষা দফতরের ডায়েরি এবং আরও অনেক কিছু।
ঠিক তার আগের দিনই দলের হয়ে ‘শহিদ দিবস’-এর সমাবেশ সামলেছেন পার্থ। ২১ জুলাইয়ের সভার আয়োজনের দায়িত্ব বরাবর তাঁকেই দিতেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্থও তাঁর নাকতলার বাড়ি থেকে সকাল সকাল স্নান সেরে, কুর্তা-পাজামা পরে ঠিক পৌনে ১১টা থেকে ১১টার মধ্যে পৌঁছে যেতেন সভাস্থলে। সে দিনও নিয়মের ব্যাত্যয় হয়নি।
বরং সভায় বৃষ্টি নামতে পার্থকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘এই বৃষ্টি আসলে বরুণ দেবের আশীর্বাদ, যা দলের উপর ঝরে পড়ছে।’’
কিছুটা পার্থের সুরে সুর মিলিয়েই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও সে দিন বলেছিলেন, ‘‘বৃষ্টি শুভ, বৃষ্টি হলে প্রতিপক্ষ ধরাশায়ী হয়েছে। আজকের সভারও লক্ষ্য তা-ই।” ঠিক পাঁচ দিন পরে অবশ্য এই অভিষেকই পার্থের গ্রেফতারির পর দলের সমস্ত পদ থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড করেছিলেন পার্থকে।
তবে এই সব যাবতীয় ঘটনা ফিকে টাকার পাহাড়ের কাছে। রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী পার্থের গ্রেফতারির আগে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ (ইডি সূত্রে এমনই দাবি করা হয়েছিল) অর্পিতার বাড়ি থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকার নগদ নোটের তাড়া উদ্ধার করে ইডিরই আরও একটি দল। সেই দৃশ্য দেখে থমকে গিয়েছিল বাংলা।
অন্য দিকে পার্থের বাড়ি থেকে পাওয়া গিয়েছিল অর্পিতার নামের দলিল। অর্পিতা যে সমস্ত সংস্থার ডিরেক্টর, তেমনই বেশ কয়েকটি সংস্থার দলিল পার্থের বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি।
২০১২ সালের টেটের পুনর্বিবেচিত ফল সংক্রান্ত নথিও পাওয়া গিয়েছিল পার্থের বাড়িতে। এ ছাড়া তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের লেখা নোট। এসএসসি কমিটি সংক্রান্ত এবং শিক্ষকদের বদলি সংক্রান্ত নথিও পাওয়া গিয়েছিল পার্থের বাড়িতে।
প্রায় ২৩ ঘণ্টা তল্লাশি চালানোর পর বিভিন্ন প্রামাণ্য নথির ভিত্তিতে এর পর ২৩ জুলাই ভোরে গ্রেফতার করা হয় পার্থকে। গ্রেফতার করে নিয়োগ মামলার আর্থিক তছরুপ সংক্রান্ত বিষয়ের তদন্তকারী সংস্থা ইডি।
সেই প্রথম বাংলা দেখল ইডির ক্ষমতা। এর আগে আর্থিক দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণকারী কেন্দ্রীয় সংস্থার কাজের সঙ্গে সে ভাবে পরিচয় হয়নি রাজ্যবাসীর। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ মামলার তদন্তে নামার কিছু দিনের মধ্যেই সেই ইডি গ্রেফতার করল একেবারে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকেই। গ্রেফতার করা হয় পার্থ ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতাকেও।
শুধু তা-ই নয়, ২২ জুলাইয়ের পর অর্পিতার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে আরও প্রায় ২৫ কোটি নগদ টাকা এবং কয়েক কেজি সোনার গহনা উদ্ধার করে ইডি। ধীরে ধীরে তাদের তদন্তে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে পার্থ এবং অর্পিতার নামে যৌথ সম্পত্তি, দু’জনের সংস্থার মধ্যে আর্থিক লেনদেন এমনকি, অর্পিতার নামে করা লক্ষ লক্ষ টাকার জীবনবিমায় নমিনি হিসাবে পার্থের নামও।
প্রতি বারই পার্থ এবং অর্পিতার বিষয়ে কিছু না কিছু অজানা তথ্য খুঁজে বার করেছে ইডি। আর প্রতি বারই অবাক হয়েছেন রাজ্যের মানুষ।
এর পর অনেক দিন কেটেছে। বার বার জামিনের আবেদন করেছেন পার্থ। পাল্টা ইডির দেখানো নানা যুক্তিতে খারিজ হয়েছে সেই আবেদন। ইডি এক সময়ে বলেই দিয়েছে, এঁদের ছেড়ে দেওয়া হলে সমাজে ভুল বার্তা যাবে। আবারও বাতিল হয়েছে জামিন। অন্য দিকে, অর্পিতা একটা সময়ের পর আর জামিনের আবেদন করেননি। কারণ হিসাবে জানিয়েছেন, তাঁর মনে হচ্ছে তিনি জেলেই অধিক সুরক্ষিত। জেলের বাইরে তাঁর উপর হামলা হতে পারে।
ইডি, সিবিআইয়ের দীর্ঘ জেরা সামলানোর পর প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়েছে পার্থকে। পার্থ-অর্পিতা দু’জনেরই বন্দিদশা ক্রমে এসে পৌঁছে এক বছর পূর্ণ হওয়ার দোরগোড়ায়। শনিবার ঘুরেফিরে আরও একটি ২২ জুলাই উপস্থিত।
ইতিমধ্যেই পার্থের মামলা লড়তে দিল্লি থেকে এসে পৌঁছেছেন অভিজ্ঞ আইনজীবী। গত ২০ জুলাই তিনি পার্থের হয়ে কলকাতার নগর দায়রা আদালতে সওয়ালও করেছেন। একটি একটি করে ‘খণ্ডন’ করেছেন পার্থের বিরুদ্ধে আনা ইডির অভিযোগের যুক্তি।
এর মধ্যেই শুক্রবার আরও একটি ২১ জুলাই সমাবেশ পালন করেছে তৃণমূল। এই প্রথম পার্থকে ছাড়া। এ বারও বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি নিয়ে সেই একই কথা বলেছেন অভিষেক, এমনকি মমতাও— বৃষ্টি শুভ।
পার্থও বলেছিলেন বৃষ্টি আশীর্বাদ। ২১ জুলাইয়ের এই বৃষ্টি কি নতুন কোনও পরিবর্তনের আশীর্বাদ আনবে, না কি বয়ে আনবে আগের বারের মতোই কোনও দুঃসংবাদ। সেটা অবশ্য এখন পুরোটাই নির্ভর করছে পার্থের নতুন আইনজীবী শামসুদ্দিন শামসের উপর। যে ভাবে পার্থের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলিকে তিনি পাল্টা যুক্তির মুখে দাঁড় করিয়েছেন, তাতে পার্থের ঘনিষ্ঠ মহলের ভরসা বেড়েছে।