কথায় আছে, ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’। অনেকটা সেই সমীকরণেই পাকিস্তান এবং চিন কাছাকাছি। আদতে দু’দেশই ভারতের ‘শত্রু’। ভারতকে বিপদে ফেলতে প্রায়ই দু’দেশের মধ্যে চলে নানান পরিকল্পনা।
ভারতীয় সেনা অবশ্য সীমান্তে সদা তৎপর। এই আবহে পাকিস্তান এবং চিন মিলে এক যুদ্ধবিমান তৈরি করেছিল। যা নতুন করে সমস্যায় ফেলেছে খোদ পাকিস্তানকেই।
কথা হচ্ছে যুদ্ধবিমান জেএফ-১৭ থান্ডার নিয়ে। পাকিস্তান এবং চিন যৌথ ভাবে ওই যুদ্ধবিমান তৈরির পরিকল্পনা করেছিল সেই ১৯৯৯ সালে। এই যুদ্ধবিমান মূলত ব্যবহার করে পাকিস্তানই। কিন্তু সক্ষমতায় বার বার ভারতের যুদ্ধবিমানের কাছে কিস্তিমাত খেয়েছে জেএফ-১৭ থান্ডার।
সেই আলোচনায় আসার আগে জেনে নেওয়া যাক, কেন আবার পাকিস্তানি এই যুদ্ধবিমান নিয়ে চর্চা শুরু হল। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, মাসখানেক আগে, ৫ জুন, ২০২৪ পাকিস্তানের পঞ্জাবের ঝাং জেলার কাছে একটি জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক ২ বিমান ভেঙে পড়েছে।
মহড়ার সময়ই এই বিপর্যয় ঘটেছে বলে খবর। যদিও ইসলামাবাদের তরফে এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে সরকারি ভাবে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে নীরব ছিল পাক সংবাদমাধ্যমও। তবে সমাজমাধ্যমে বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো ঘটনাটি নিশ্চিত বলে দাবি করেছে। যদিও সেই সব ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
বলা হচ্ছে, জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান গত ১৩ বছরে এই নিয়ে পঞ্চম বার দুর্ঘটনার সম্মুখীন হল। তার পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, বার বার কেন একই রকম ঘটনা ঘটছে অত্যাধুনিক এই যুদ্ধবিমানের সঙ্গে? চিনের সঙ্গে যৌথ ভাবে জেএফ-১৭ থান্ডার তৈরির পরিকল্পনা কি পাকিস্তানের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?
জেএফ-১৭ থান্ডার হল একটি একক ইঞ্জিনবিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর ক্ষেত্রে জেএফ-১৭ থান্ডার প্রায় মেরুদণ্ডের মতো। এটি ভারতের তেজসের মতো লাইটওয়েট মাল্টি-রোল ফাইটার জেট।
মাল্টি-রোল ফাইটার জেটের বৈশিষ্ট্য কী? অনেক উঁচু থেকে হামলা চালানো, মাটির খুব কাছাকাছি নেমে গোলাবর্ষণ করা, প্রতিপক্ষের যুদ্ধবিমানকে তাড়া করা, প্রতিকূল আকাশসীমায় ঢুকে বিপক্ষের ঘাঁটি এবং সমরসজ্জার নির্ভুল খবর নিয়ে আসা— এই সব কাজই করতে পারে এই যুদ্ধবিমানগুলি।
পাকিস্তানের অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স (পিএসি) চিনের চেংডু এয়ারক্র্যাফ্ট ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশনের সঙ্গে যৌথ ভাবে জেএফ-১৭ তৈরি করে থাকে। ১৯৯৯ সালে এই যুদ্ধবিমান তৈরির ব্যাপারে দুই দেশ নিজেদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করে। তার ১০ বছর পর জেএফ-১৭ থান্ডার পাক বিমানবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।
পাকিস্তানে এই বিমানের ৫৮ শতাংশ তৈরি হয়। চিন তৈরি করে বাকি অংশ। ফ্রান্স বা চিনের তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলির উত্তরসূরি হিসাবে জেএফ-১৭ থান্ডারকে ধরা হয়েছিল। তবে তা কি সত্যি সেই উচ্চতায় পৌঁছতে পেরেছে? এই বিষয়ে সমর বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
অনেক বিশেষজ্ঞই দাবি করেন, ভারতীয় লাইটওয়েট মাল্টি-রোল ফাইটার জেট তেজসের সঙ্গে সম্মুখসমরে যাওয়ার লক্ষ্যেই জেএফ-১৭ থান্ডার তৈরি করা হয়। এই যুদ্ধবিমানে চিনের দেওয়া আরডি-৯৩ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এই যুদ্ধবিমান বার বারই সমস্যার মুখে পড়েছে। তবে সেই কথা জানার আগে জেনে নেওয়া যাক এই বিমানের কিছু কার্যক্ষমতার কথা। জেএফ-১৭ থান্ডার একবারে পাড়ি দিতে পারে ২০০০ কিলোমিটারের মতো পথ।
২৩০০ কিলোগ্রামের বেশি জ্বালানি বহন করতে পারে না এই বিমান। মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরার সুবিধা নেই এতে। ফলে জ্বালানি শেষ হওয়ার আগে ফিরতেই হয় বিমানগুলিকে।
জেএফ-১৭ থান্ডার তৈরি স্টিল অ্যালয় আর অ্যালুমিনিয়ামে। ফলে তেজসের চেয়ে থান্ডারের ওজন অনেক বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষিপ্রতা কম। তাই মাঝ আকাশে তেজস সব দিক থেকে টেক্কা দেয় জেএফ-১৭ থান্ডারকে।
২০২১ সালে এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) অনিল চোপড়া এক সাক্ষাকারে দাবি করেছিলেন, জেএফ-১৭ থান্ডারের ইঞ্জিন নিম্ন মানের। ভারতের তেজস সেই তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।
শোনা গিয়েছিল, জেএফ-১৭ থান্ডারের ইঞ্জিন রাশিয়ার কোনও সংস্থার তৈরি ইঞ্জিনের সঙ্গে প্রতিস্থাপিত করা হবে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই সেই পরিকল্পনা বিশ বাঁও জলে।
শুধু ইঞ্জিন নয়, জেএফ-১৭ থান্ডার আরও অনেক প্রযুক্তিগত সমস্যার মুখোমুখি হয়। যা অতিক্রম করার পথ এখনও খুঁজে পায়নি পাকিস্তান। কম সহনশীলতা, নির্ভুল লক্ষ্যভেদের অপারগতা, কম পেলোড বহনের ক্ষমতা-সহ একাধিক সমস্যায় জর্জরিত জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান।
শুধু পাকিস্তান নয়, মায়ানমারের মতো দেশগুলিও এই জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান কিনেছে। কিন্তু সেই ক্রয় তাদের জন্য বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও জানান মায়ানমারের বিমানবাহিনীর প্রাক্তন পাইলটেরা। তাঁদের মতে, এই বিমানে কাঠামোগত এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত সমস্যা রয়েছে। মায়ানমার ২০১৬ সালে চিনের সঙ্গে চুক্তি করে ১৬টি জেএফ-১৭ ক্রয় করেছিল। সেগুলি এখন তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মায়ানমারের পাশাপাশি নাইজেরিয়াও ২০১৬ সালে একই চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০২১ সালে তাদের যুদ্ধবিমানের ভান্ডারে যুক্ত হয়েছে জেএফ-১৭ বিমান।
পাকিস্তান দাবি করেছে, ২০২৪-২০২৫ এর মধ্যেই জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমানকে আরও উন্নত করে তোলার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। উচ্চতর ব্লক ৩ ভ্যারিয়েন্ট লঞ্চ করবে। যা শত্রুদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে।