তোষাখানার উপহার নিয়ে বার বার বিতর্ক তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে। সেই উপহার বিক্রির অভিযোগও উঠেছে। এ বার তোষাখানার উপহারের একটি তালিকা প্রকাশ করল পাকিস্তান সরকার। ২০০২ সাল থেকে তোষাখানায় যত উপহার জমা পড়েছে, সেই নথি প্রকাশ্যে এল। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই ঘটনা আগে হয়নি।
দেশের সরকার এবং বিদেশি রাষ্ট্র থেকে সরকারি প্রতিনিধিরা যে উপহার পান, তাই জমা করা হয় তোষাখানায়। দিন কয়েক আগে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জানিয়েছিলেন, এই তোষাখানার নথি প্রকাশে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে সরকার। তার পরেই প্রকাশিত হল নথি।
পাক সরকার ৪৪৬ পাতার একটি নথি প্রকাশ করেছে। ২০০২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তোষাখানায় যা যা উপহার জমা পড়েছে, তা ওই নথিতে রয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টরা ওই সময়কালে যা যা উপহার পেয়েছেন, তা-ও রয়েছে নথিতে।
২০২৩ সালে নতুন পাক সরকারের প্রতিনিধি এবং আধিকারিকেরা বিভিন্ন দেশ থেকে ৫৯টি উপহার পেয়েছেন।
সরকারি নথিতে লেখা রয়েছে, ২০২২ সালে সরকারি প্রতিনিধি, আধিকারিকেরা ২২৪টি উপহার পেয়েছেন। ২০২১ সালে তাঁদের পাওয়া উপহারের সংখ্যা ১১৬। ২০১৮ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ১৭৫, ২০১৫ সালে সংখ্যাটা ছিল ১৭৭। ২০১৪ সালে ৯১টি উপহার জমা পড়েছে তোষাখানায়।
প্রাক্তন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজ, ইউসুফ রাজা গিলানি, রাজা পারভেজ আশরফ, ইমরান খান, নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় থাকার সময় বিদেশি রাষ্ট্র থেকে কী কী পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাও লেখা রয়েছে নথিতে।
প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় উপহার পাওয়া কিছু জিনিস পরে দাম দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন ইমরান খান এবং তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবি। অভিযোগ, জিনিসগুলির যা দাম ছিল, তার থেকে অনেক কম টাকা দিয়ে সেগুলি কিনেছিলেন তিনি। সরকারের প্রকাশ করা নথিতে সেই তথ্যও রয়েছে।
তোষাখানার নথি থেকে জানা গিয়েছে, প্রায় ৮ কোটি ৫০ লক্ষ পাকিস্তানি মুদ্রার সোনা এবং হিরে বসানো ঘড়ি তোষাখানা থেকে কিনে নিয়েছিলেন ইমরান। তিনিই ঘড়িটি পেয়েছিলেন। এর আগে বা পরে কোনও পাক প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট বা কোনও মন্ত্রী এত দামি উপহার পাননি। অভিযোগ, আসল দামের থেকে অনেক কম দামে ইমরান কিনেছিলেন সেটি।
ঘড়িতেই শেষ নয়। ৫৬ লক্ষ পাকিস্তানি মুদ্রার কাফলিঙ্ক, ১৫ লক্ষ পাকিস্তানি মুদ্রার পেন, ৮৭ লক্ষ পাকিস্তানি মুদ্রার আংটিও কিনে নিয়েছিলেন ইমরান। ওইগুলিও তিনি উপহার হিসাবে পেয়েছিলেন। হিরের ঘড়ি-সহ ওই জিনিসগুলি পরে মাত্র ২ কোটি পাকিস্তানি মুদ্রার বিনিময়ে কিনে নিয়েছিলেন তিনি। সেই নিয়েই তৈরি হয় বিতর্ক।
পাকিস্তান তেহরিক ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রধান ইমরান আরও একটি ঘড়ি কম দামে কিনে নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ঘড়িটির দাম ছিল প্রায় ৩৮ লক্ষ ৮০ হাজার পাকিস্তানি মুদ্রা। ইমরান মাত্র ৭ লক্ষ ৫৪ হাজার পাকিস্তানি মুদ্রায় সেই ঘড়ি কিনে নিয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালে এই তোষাখানা স্থাপন করে পাকিস্তান। নিয়ম হয়, সরকারি আধিকারিক থেকে আমলা, সংসদের প্রতিনিধিরা যা উপহার পাবেন, তা তোষাখানায় জমা করতে হবে। ১০ হাজার পাকিস্তানি মুদ্রার কম দামি জিনিস শুধু নিজের কাছে রাখতে পারবেন সরকারি প্রতিনিধি, মন্ত্রী, আমলারা। পাক সংবাদপত্র ডন দাবি করেছে, উপহারের দামের একটা অংশ মিটিয়ে দিলে তা নিজের কাছে রাখতে পারেন সরকারি প্রতিনিধি। তবে দামের কত অংশ, তা স্পষ্ট নয়।
যদিও বার বার সেই নিয়ম ভাঙা হয়েছে পাকিস্তানে। সব থেকে বেশি অভিযোগ উঠেছে ইমরানের বিরুদ্ধে। ভোটে মনোনয়ন জমা করার সময় যে হলফনামা দিয়েছিলেন তিনি, তাতে ওই সব উপহার কেনার উল্লেখ ছিল। তার পরেই নড়েচড়ে বসে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। তদন্ত শুরু করে। এর পরেই কম দামে উপহার কেনার কথা প্রকাশ্যে আসে।
এর পরেই গত বছর জাতীয় অ্যাসেম্বলি থেকে ইমরানকে বহিষ্কার করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের অভিযোগ, ইমরান তোষাখানার উপহার কিনে নেওয়ার কথা গোপন করেছেন। জেলা এবং দায়রা আদালতে এই নিয়ে মামলাও চলছে। তার পরেই তোষাখানায় দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এ বার তাতে স্বচ্ছতা আনতে তালিকা প্রকাশ করল পাকিস্তানের শাহবাজ শরিফ সরকার। তবে ইমরান একা নন, বেশ কয়েক জন রাষ্ট্রপ্রধান, নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই এই উপহার নিয়ে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। নিন্দকরা বলছেন, ভূত আসলে সরষেতেই। তাই নথি প্রকাশ করেও খুব বেশি লাভ হবে না।