পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা কারও অজানা নয়। এক দিকে যেমন দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল, অন্য দিকে তেমন জীবিকা নির্বাহের জন্য সেখানে নিত্য সংগ্রাম লেগেই আছে।
কয়েক সপ্তাহ আগেও জীবিকার হাহাকার দেখা গিয়েছে পাকিস্তানে। সাধারণ দুধের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। বিনামূল্যে ময়দা পাওয়ার জন্য ট্রাকের পিছনে দৌড়েছিলেন সাধারণ মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল।
পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার তলানিতে ঠেকেছে। বিশ্ব অর্থ ভান্ডার ঋণ দিতে অস্বীকার করায় অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে ভারতের এই পড়শি দেশে। চাপ সামলাতে বিদেশ থেকে আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যথাসম্ভব।
সেই পাকিস্তানেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেফতারি নিয়ে নতুন করে অশান্তি শুরু হয়। ইমরানকে গ্রেফতারির প্রতিবাদে পথে নামেন অনেকে। ইতিহাসে প্রথম, সেনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখা যায় পাকিস্তানের রাস্তায়।
যে দেশে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন টালমাটাল, সেখানেই কিন্তু দেখা যায় সম্পূর্ণ উল্টো চিত্রও। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উপর এই অর্থসঙ্কটের কোনও প্রভাবই পড়ে না।
জিডিপির বিচারে পাকিস্তান বিশ্বে ৪২তম স্থান অধিকার করে আছে। অথচ, সামরিক শক্তির দিক থেকে বিশ্বের তালিকায় এই দেশ প্রথম সারিতে। পাকিস্তানের সেনা সপ্তম স্থানে রয়েছে সেই তালিকায়। যা ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ইটালি, ইজরায়েলের মতো দেশের চেয়েও উপরে।
পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হল সেই দেশের সেনা। তাদের অধীনে রয়েছে স্কুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা। রয়েছে রাজস্ব আদায়ের বহু মাধ্যম।
পাক সেনায় এই মুহূর্তে কর্মরত ৫ লক্ষ ৬০ হাজার জওয়ান। দু’হাজার ট্যাঙ্ক, চার হাজারের বেশি অত্যাধুনিক কামান, ৪২৫টি যুদ্ধবিমান এবং সাবমেরিন রয়েছে পাক সেনার হাতে।
এ ছাড়াও, পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে চিনা সেনাবাহিনীর সমর্থন। যা তার শক্তি বৃদ্ধি করেছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে চিনের সেনাবাহিনী পাকিস্তান বা ভারতের চেয়ে উন্নত।
পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যায় ভারতের চেয়েও এগিয়ে পাকিস্তান। সে দেশের সেনার কাছে খাতায়কলমে ১৫০টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। ভারতের কাছে রয়েছে ১৪০টি।
১৯৯৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে পাকিস্তান সরকার যত পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে, তার ২০ শতাংশ খরচ হয়েছে সেনার উন্নয়নের স্বার্থে। যা দেশের বাজেটের এক পঞ্চমাংশ।
সরকারের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ ছাড়াও স্বতন্ত্র ভাবে পাক সেনার রোজগার আকাশছোঁয়া। তাদের অধীনে স্কুল থেকে শুরু করে চাষযোগ্য বিপুল জমি, রয়েছে সবই। পরিসংখ্যান বলছে, পাক সেনার অধীনে রয়েছে সে দেশের মোট ভূখণ্ডের ১২ শতাংশ জমি।
পাকিস্তানে সেনাই সর্বেসর্বা। গণতান্ত্রিক দেশ হলেও এখানে সেনার কথাই শেষ কথা। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, জনগণ দ্বারা নির্বাচিত কোনও সরকারই পাকিস্তানে আজ অবধি পাঁচ বছর টিকতে পারেনি। বার বার এই দেশ দেখেছে সামরিক শাসন।
পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক গোষ্ঠী ফৌজি ফাউন্ডেশন। আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে সেনা পরিচালিত এই ব্র্যান্ডের বিনিয়োগ রয়েছে। কৃষি, ব্যাঙ্ক, সিমেন্ট, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা চালায় সেনার এই ফাউন্ডেশন।
পাকিস্তানের সেনা ৫০টিরও বেশি আলাদা আলাদা সংস্থার মালিক। যেখান থেকে সারা বছরে ২,৬৫০ কোটি ডলার আয় হয়। এই পরিসংখ্যান ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানি কিংবা মুকেশ অম্বানীদের আয়ের চেয়েও বেশি।
২০০৭ সালেই জানা গিয়েছিল, পাকিস্তানের সেনার মোট সম্পত্তি ছিল ১ হাজার কোটি পাউন্ড। ভারতীয় মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। ২০০৭ সালে পাকিস্তানে যত বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছিল, সেনার এই সম্পত্তি তার চেয়েও ৪ শতাংশ বেশি।
পাক সেনার এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির কথা কারও অজানা নয়। সেনাবাহিনীতে চাকরি পাওয়া সে দেশের তরুণদের কাছে স্বপ্নের মতো। যে কোনও পাক সেনা আধিকারিকই কোটিপতি।
পাকিস্তানের কোনও মেজর জেনারেল অবসর গ্রহণ করলে তাঁকে সেনার তরফে উপহার হিসাবে ২৪০ একর চাষযোগ্য জমি দান করা হয়। সেনা আধিকারিকদের সন্তানেরা সাধারণত বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করেন। তার পর দেশে ফিরলে সেনার অধীন কোনও সংস্থাতেই তাঁদের চাকরি দেওয়া হয়।
পাক সেনায় বিলাসিতার অভাব নেই। সরকারের উপর ছড়ি ঘোরায় এই সেনাই। অথচ, সরকার এবং দেশরক্ষার জন্যই সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল।
দেশে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা না থাকার জন্যই সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। সেই সেনার শাসনের অজুহাতে পাকিস্তানে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পিছিয়ে যান বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা। অভ্যন্তরীণ সংস্থা দিয়েও কাজ হয় না। ফলে মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য এগিয়ে আসে ফৌজি ফাউন্ডেশনের মতো সেনা অধিকৃত সংগঠন। তারাই অর্থনৈতিক ভাবে ফুলেফেঁপে ওঠে।
এ ভাবেই সেনার শক্তি আরও বেড়ে চলে। দেশে স্থিতিশীল সরকার গঠন না করে সেই সেনা ক্ষমতা নিজেদের হাতেই রেখে দেয়। ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট কখনও কাটে না।