কোষাগার প্রায় খালি। বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার তলানিতে। ফলে ধারবাকিই ছিল ভরসা। অর্থের জোগান মেটাতে সরকারি উড়ান সংস্থা বন্ধক রেখেছিল পাকিস্তান। কিন্তু তাতেও ঘরে পর্যাপ্ত অর্থ না আসায় শেষ পর্যন্ত তা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সরকার। গোল বেধেছে সেখানেও। ওই বিমান সংস্থা কিনতে চাইছেন না কেউ।
সম্প্রতি ‘পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স’(পিআইএ)-এর অধিকাংশ শেয়ার বিক্রির কথা ঘোষণা করে ইসলামাবাদ। ৩১ অক্টোবর সেই নিলামের দিন ধার্য করা হয়েছিল। উদ্বেগের বিষয় হল একজন ছাড়া আর কেউ নিলামে অংশ নিতে রাজি হননি। ফলে বিক্রি পিছোতে পারে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির আইন অনুযায়ী, নিলামে অংশ নিতে হলে আগেভাগে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হয়। পাক সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, পিআইএর নিলামে অংশ নিতে এক জন মাত্র সেই নথি জমা করেছেন। এর আগে অবশ্য সংস্থাটির ৬০ শতাংশ অংশীদারি হাতে পেতে ছ’টি সংস্থা নিলামে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছিল।
পাক সরকারি উড়ান সংস্থা কিনতে চাওয়া সংস্থাগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে নাম ছিল ফ্লাই জিন্নাহ, এয়ারব্লু এবং আরিফ হাবিব কর্পোরেশনের। এ ছাড়াও লড়াইয়ে ছিল ওয়াইবি হোল্ডিংস (প্রাইভেট) লিমিটেড, পাক ইথানল ও ব্লু ওয়ার্ল্ড সিটি।
পাক সংবাদ সংস্থা ‘দ্য নিউজ় ইন্টারন্যাশনাল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরে নিলাম থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয় পাঁচটি সংস্থা। এর পিছনে পিআইএর বিরাট অঙ্কের ঋণকে মূলত দায়ী করেছেন তারা। সেই আর্থিক দায়ভার নিতে রাজি নয় কোনও সংস্থা। পাশাপাশি এর একাধিক অপারেশনাল অসুবিধা রয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।
এই অবস্থায় নিলামের আগ্রহ বাড়াতে শেয়ার বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করে পাক সরকার। ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৭৬ শতাংশ অংশীদারি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা করে শরিফ প্রশাসন। কিন্তু তার পরেও চিঁড়ে ভেজেনি। একটি মাত্র সংস্থা ছাড়া বাকিদের কেউই ফিরে আসেনি।
দ্য নিউজ় ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, পিআইএর হাতে বর্তমানে যে ক’টি উড়ান রয়েছে তার মধ্যে ছোট বিমানকে আকাশে উড়াতে গেলেও মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। যার পরিমাণ আনুমানিক ৫০ কোটি ডলার। ওই টাকায় শুধুমাত্র বিমানগুলিকে নতুন করে সাজানো এবং ওড়ানোর মতো অবস্থায় আনা যাবে বলে জানা গিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বছরে আর্থিক সঙ্কটের জেরে ইউরোপ এবং আমেরিকার বহু রুট বন্ধ করে দিয়েছে পিআইএ। ফলে এই উড়ান সংস্থার প্রতি যাত্রীদের আকর্ষণ কমেছে। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ওই রুট চালু করতে না পারলে পিআইএ বিক্রির সম্ভাবনা কম। কারণ, সে ক্ষেত্রে একে কোনও ভাবেই লাভজনক সংস্থায় পরিণত করা যাবে না।
পাক প্রশাসন জানিয়েছে, পিআইএর শেয়ার কিনতে একমাত্র যে সংস্থা এগিয়ে এসেছে, তার নাম ‘ব্লু ওয়ার্ল্ড সিটি’। যা প্রকৃতপক্ষে একটা রিয়েল এস্টেট সংস্থা। এই পরিস্থিতিতে নিলাম হলে একাধিক প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে নিলাম পিছোতে চাইছে শরিফ প্রশাসন। তবে এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
শরিফের আগে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন একবার পিআইএ বিক্রির কথা হয়েছিল। কিন্তু বিরোধীদের চাপে শেষ পর্যন্ত তা করা যায়নি। পরে উড়ান সংস্থাটির আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরাতে এতে ব্যাপক ছাঁটাই করে ইমরান প্রশাসন। যা নিয়ে সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়েছিল তাঁকে।
বর্তমানে শাহবাজ শরিফও জোট সরকারে রয়েছেন। ফলে পিআইএ বিক্রির ব্যাপারে অতি সাবধানতা নিচ্ছে তাঁর সরকার। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তিনি যে বিপাকে পড়বেন তা বলাই বাহুল্য। শুধু তাই নয়, শরিক দলগুলির সমর্থন হারাতে পারেন ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ)’-এর এই নেতা।
ভারত ভেঙে পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার বছর খানেক আগে ১৯৪৬ সালের ২৯ অক্টোবর পিআইএ-র জন্ম হয়। ১৯৫৫ সালের ১১ মার্চ থেকে পুরোদস্তুর যাত্রী পরিবহণ শুরু করে এই উড়ান সংস্থা। প্রাথমিক ভাবে করাচির ‘জিন্না আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ থেকে মিলত এর পরিষেবা। পরবর্তীকালে লাহোরের ‘আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ এবং ইসলামাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও যাত্রী পরিবহণ শুরু করে এই বিমান সংস্থা।
পাকিস্তানের জন্মের পর পিআইএর জাতীয়করণ করে সেখানকার সরকার। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে মিশরের রাজধানী কায়েরো থেকে ইটালির রোম হয়ে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের লন্ডন শহর পর্যন্ত পরিষেবা দিত এই উড়ান সংস্থা। ১৯৬৪ সালে প্রথমবার চিনের মাটি ছুঁয়েছিল এই উড়ান সংস্থার বিমান।
২০২০ সালের ৩০ জুন পিআইএর উড়ান ছ’মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। সেই সময়ে ছিল ভরা কোভিড কাল। এর পর পাক সরকারি উড়ান সংস্থাটির আর্থিক সঙ্কট বাড়তে শুরু করে। সেখান থেকে আর কখনই বেরিয়ে আসতে পারেনি এই সংস্থা।
২০২০ সালের শেষের দিকে ‘ইউরোপীয়ান অ্যাভিয়েশন সেফটি এজেন্সি’-র তরফে পাক বিমানগুলির অবস্থা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এই উড়ান সংস্থা পরিষেবা দিতে অক্ষম। যার জেরে এর যাত্রী সংখ্যা অনেকটা কমে গিয়েছিল।