২০১০ সালের পর আবার ভয়াবহ বন্যায় ডুবে গিয়েছে পাকিস্তান। জলমগ্ন দেশের এক-তৃতীয়াংশ। এখনও পর্যন্ত হাজারেরও বেশি মৃত। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটির। ধুঁকতে থাকা পাক অর্থনীতিকে চাপে ফেলে এই বন্যায় সে দেশের প্রতি সাত জনের মধ্যে এক জন ক্ষতিগ্রস্ত।
জুন থেকে অবিরাম বৃষ্টির জেরে জলমগ্ন পাকিস্তান। সে দেশের বন্যার এই ভয়াল চেহারায় পাক সরকারের মতোই চিন্তিত রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস।
পাকিস্তানের বন্যাকে ‘প্রবল সঙ্কট’ আখ্যা দিয়ে গুতেরেসের মন্তব্য, ‘‘দুর্ভোগে ডুবে রয়েছে প্লাবিত পাকিস্তান। পাকিস্তানিরা স্টেরয়েডযুক্ত বর্ষার মুখে পড়েছেন। বৃষ্টি এবং বন্যার অবিরাম প্রভাব চলছে।’’ পাকিস্তানের জন্য বিশ্বের দরবারে ১৬ কোটি ডলারের অর্থসাহায্যের আবেদনও করেছেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবই যে পাকিস্তানের বন্যার পিছনে অনেকাংশে দায়ী, তা মনে করছে রাষ্ট্রপুঞ্জ তথা পাক প্রশাসন। সঙ্কট মেটাতে আন্তর্জাতিক সাহায্যের আর্জি জানিয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত তিন কোটি ৩০ লক্ষ বাসিন্দা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
পাক পঞ্জাবের রোজহান শহরের একটি উপগ্রহ চিত্রে দেখা গিয়েছে, বন্যার জেরে প্রায় গোটা শহর জলকাদার তলায় চলে গিয়েছে। মার্চের শেষ দিকে উপগ্রহ মানচিত্রে শহরের যে সব জায়গায় ঘরবাড়ি, গাছপালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল, বন্যায় আজ তা প্রায় নিশ্চিহ্ন।
২০১০ সালেও এ ধরনের এক ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল পাকিস্তান। দু’হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল সে বারের বন্যা। তবে সরকারি পরিসংখ্যান জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত চলতি বন্যায় অন্তত ১,১৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকা থেকে বহু বাসিন্দার আশ্রয় হয়েছে পাকিস্তানের দক্ষিণ এবং পশ্চিম প্রান্তের জাতীয় সড়ক ও রেললাইনে।
বন্যার জেরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ পাননি সে দেশের বহু বাসিন্দা। গোদের উপর বিষফোঁড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম। বালুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার বাসিন্দা সাদিয়া বলেন, ‘‘এখানে একটাও বাড়ি পাওযা যাবে না, যাকে নিরাপদ বলা যায়। কোনও সাহায্য ছাড়াই খোলা আকাশের নীচে বাস করতে হচ্ছে।’’
সাদিয়া আরও বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে আমাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন। তাঁবু, ফার্স্ট এড আর কিছু খাবার দরকার। রান্না করব কী ভাবে? খাওয়ার জন্য পরিষ্কার জলই তো নেই!’’
বন্যা ভাসিয়ে নিয়েছে একরের পর একর কৃষিজমি। যার জেরে কৃষিজাত দ্রব্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। তার প্রভাবে বেড়েছে খাদ্যসামগ্রীর দাম।
খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়া বাসিন্দাদের অনেকের কাছে অধরা হয়ে গিয়েছে নিত্যদিনের জিনিসপত্র। সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে লাহৌরের বাসিন্দা জুবেদা বিবি বলেন, ‘‘বন্যার জন্য জিনিসপত্রের দাম এতটাই চড়া যে আমাদের কিছুই কেনার ক্ষমতা নেই।’’
পাকিস্তানের পরিকল্পনা মন্ত্রকের দাবি, সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্তত হাজার কোটি ডলার।
পাক সরকারের আহ্বানে আন্তর্জাতিক স্তর থেকে সাড়া মিলেছে। সোমবার পাকিস্তানকে তড়িঘড়ি ১১০ কোটি ডলারের ঋণ মঞ্জুর করেছে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ)।
পাকিস্তানকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে মোদীর টুইট, ‘পাকিস্তানে বন্যায় এই ধ্বংসলীলা দেখে অত্যন্ত ব্যথিত। হতাহতদের পরিবার, আহত এবং এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সকলের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই এবং স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত পুনরুদ্ধারের আশা করি।’
বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খাইবারপাখতুনখোয়ার পাহাড়ি অঞ্চল, সিন্ধু এবং বালুচিস্তান প্রদেশ। উত্তরাঞ্চলের সোয়াট উপত্যকার গ্রামগুলি থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। তবে ওই গ্রামে উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে উদ্ধারকারী দল। সংযোগরক্ষাকারী সমস্ত সেতু, রাস্তা জলে ভাসছে। হেলিকপ্টারের সাহায্যে উদ্ধারকাজও অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে।
রবিবার হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন পাক প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘গ্রামের পর গ্রাম বন্যার জলে ভেসে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি।’’ এরই মধ্যে সে দেশে পৌঁছেছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং তুরস্কের সাহায্য। ওষুধ, তাঁবু পাঠিয়েছে ওই দু’দেশ। অন্য দিকে, ভারত সরকারের মতোই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমেরিকা এবং ব্রিটেন। আপাতত সে সাহায্যের আশায় পাকিস্তান।