এই কয়েক দিন আগে পর্যন্ত বাবর আজ়মকে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটার বলে দাবি করে এসেছেন পাকস্তান ক্রিকেট দলের প্রাক্তনীরা। সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাবরের অধিনায়কোচিত ইনিংস দেখে বিরাট কোহলির আগে তাঁকে জায়গা দেন শোয়েব আখতার। এখন টি-২০ বিশ্বকাপে পর পর হারের দায় সেই বাবরকে দিচ্ছেন শোয়েব। একই সঙ্গে বাবরের ব্যাটিং নিয়েও উঠেছে সমালোচনার ঝড়।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির লোদি রাজবংশের সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। ভারতজয় নিয়ে অতীতস্মরণ করে মুঘল সম্রাট লিখেছিলেন, ‘সমরকন্দ পুনরুদ্ধার ছিল আল্লাহ্র দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।’ তাঁর নামের সঙ্গে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়কের নামের মিল আছে। আর মিল আছে একটি জায়গায়।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম বার ভারতকে পরাজিত করে বাবরের পাকিস্তান। বস্তুত, ৫০ ওভার এবং ২০ ওভারের বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে সেটিই ছিল পাকিস্তানের প্রথম জয়। বাবর-বাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন পাকিস্তানের ক্রিকেট মহল।
কিন্তু এক বছরে এল বদল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এ বার হেরেই চলেছে পাকিস্তান। প্রথমে ভারতের বিরুদ্ধে রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে হারের পরে জ়িম্বাবোয়ের মতো ‘দুর্বল’ দলের কাছেও হেরেছেন বাবর আজ়মরা। আর তার পরেই শুরু হয়েছে বিদ্রুপ, সমালোচনা এবং আক্রমণ।
প্রথমে ব্যাট করে ১৩০ রান করেছিল জ়িম্বাবোয়ে। কিন্তু সেই রান তাড়া করতে গিয়ে চাপে পড়ে পাকিস্তান। পর পর উইকেট হারাতে থাকে তারা। শেষ পর্যন্ত ১ রানে হারতে হয় বাবরদের।
ভারতের বিরুদ্ধে ওপেনার বাবরের সংগ্রহ ছিল শূন্য! আর জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে বাবর করেন ৯ বলে ৪ রান।
শেষ ওভারে পাকিস্তানের জিততে দরকার ছিল ১১ রান। একটি চার মারেন ওয়াসিম। শেষে ২ বলে জেতার জন্য ৩ রান দরকার ছিল। কিন্তু শেষ বলে ২ রান নিতে গিয়ে রানআউট হন শাহিন আফ্রিদি। ১ রানে ম্যাচ হারে পাকিস্তান। ফলে এ বার কার্যত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাচ্ছে পাকিস্তান।
এর পর অধিনায়ক বাবর যেমন সমালোচিত হচ্ছেন, ব্যাটার বাবরও পড়েছেন বিদ্রুপের মুখে। যেমন শোয়েব আখতার বলছেন, ‘‘বাবর জঘন্য অধিনায়ক। ওর কোনও পরিকল্পনা নেই!’’ তাঁর সংযুক্তি, ‘‘ভারতের বিরুদ্ধেও ওর (বাবর) জন্য হেরেছিলাম। বার বার মহম্মদ নওয়াজ়কে শেষ ওভারে বল করার জন্য ধরে রাখে আর বার বার আমরা হারি। দলে চার জন পেসার খেলানো উচিত। সেখানে বাবর তিন জনকে খেলাচ্ছে। তার মধ্যে শাহিন সুস্থ নয়। তার পরেও ওকে নামিয়ে দিয়েছে। আরও তো পেসার আছে। তাদের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।’’
এখানেই শেষ নয়। আখতার পরামর্শের সুরে বলেছেন, ‘‘আমি কত বার বলেছি, বাবরের তিন নম্বরে নেমে আসা উচিত। কিন্তু ও শুনবে না! সেই ওপেন করবে। দু’জনের উপরই পুরো দল নির্ভর করছে। মিডল অর্ডারে কোনও ব্যাটার নেই। ফখর জ়মানকে বসিয়ে রেখেছে। শোয়েব মালিককে নেওয়ার কথা বলেছিলাম। ওকেও নিল না। ভুল দল নিয়ে খেললে হার ছাড়া আর কী হবে?’’
প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে অফ ফর্মে থাকা বাবর অবশ্য বলছেন তাঁর কোনও ভুল নেই। মিডল অর্ডারকেও দায়ী করতে রাজি নন তিনি। বাবরের যুক্তি, অস্ট্রেলিয়ায় অতিরিক্ত পেসার নিয়ে খেলতে চেয়েছিলেন তিনি। সে হিসাবেই দল সাজিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ফল ভাল হয়নি।
তবে জ়িম্বাবোয়ের কাছে হারের পর বাবর বলছেন, ‘‘আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরব আমরা।’’ কিন্তু ২৮ বছরের ব্যাটারের ফর্ম এবং অধিনায়কত্ব নিয়ে তাঁকে ‘রক্তাক্ত’ করছেন দেশের সমালোচক এবং প্রাক্তনরাই।
বিরাট কোহলির মতো পাকিস্তানের বাবর আজ়মও খুব অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় দলে পাকা জায়গা করে নিয়েছিলেন। ডান হাতি ব্যাটারের জিম্মায় রয়েছে বহু রেকর্ড।
২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে এক দিনের সিরিজে পর পর ৩টি সেঞ্চুরি এবং টেস্টে ৯০ রান করে ক্রিকেট দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলে দেন বাবর। তার পর একের পর এক ম্যাচে নিজের জাত চিনিয়েছেন। ক্রিকেট দুনিয়াকে বুঝিয়েছেন, তিনি থাকতে এসেছেন।
২০১০ এবং ২০১২ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাবর ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী।
২০১৫ সালে যে জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিকে়ট জীবন শুরু করেন, তাদের কাছে হারলেন ২০২২ সালে এসে। এবং এমন একটি ম্যাচে পরাজয় এল যেখানে পাক ক্রিকেটপ্রেমীরা আশা করেছিলেন, খুব সহজে জিতবেন বাবররা।
এক দিনের ক্রিকেটে দ্রুততম ২ হাজার রানে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে বাবর। টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম হাজার রানেও বাবর দ্বিতীয় স্থানে। সেই আজ়মের অফ ফর্ম প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে তাঁর ‘সাম্রাজ্য’ নিয়ে।
এই জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে একাধিক চোখধাঁধানো ইনিংস রয়েছে বাবরের। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের বোলারদের উপর সজোর ‘আঘাত’ ক্রিকেটপ্রেমীদের বাবরকে করেছে ‘জ়িমবাবর’। কিন্তু সেই দলের কাছে হেরে গিয়ে কটাক্ষের শিকার হচ্ছেন বাববর। নেটাগরিকদের ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য, ‘এ বার তো জ়িমবাবরও বলতে পারব না!’
ভারতের পর জ়িম্বাবোয়ের কাছেও হেরে সেমিফাইনালে যাওয়া কঠিন করে ফেলেছে পাকিস্তান। দলের এমন হারের পর কৈফিয়ত দিয়েছেন অধিনায়ক বাবর। তাঁর কথায়, ‘‘দলের খেলা খুব হতাশাজনক। ব্যাটিং একদমই ভাল হয়নি। প্রথম ৬ ওভারে খুব খারাপ ব্যাটিং করেছি। শাদাব খান এবং শান মাসুদ জুটি ক্রিজে জমে গিয়েছিল। কিন্তু শাদাবের আউট হয়ে যাওয়াটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। এর পরেই একের পর এক উইকেট পড়তে থাকে।’’
জ়িম্বাবোয়ের কাছে হারের কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে বাবর এ-ও বলছেন, ‘‘ব্যাটারদের উপর চাপ বাড়ছিল। দলের সবার সঙ্গে বসব। এই ম্যাচের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেব। পরের ম্যাচে দাপটের সঙ্গে ফিরে আসব আমরা।’’
যদিও বাবরের দলের পরাজয়ের পর পাকিস্তানের প্রাক্তনীরা বলছেন, বিদেশে কম খেলাই কাল হয়েছে দলের। শুধু পাকিস্তানের কোনও মাঠ, নয়তো দুবাইয়ে খেলা— এটাই পাক ক্রিকেটের সর্বনাশ করছে বলে মন্তব্য করেছেন এক প্রাক্তন ক্রিকেটার।
আজ়মের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন পাক ক্রিকেটার মহম্মদ হাফিজ। কটাক্ষের সুরে বলেছেন, ‘‘ব্যাপারটা এখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, বাবরের অধিনায়কত্ব নিয়ে সমালোচনা করাও পাপের পর্যায়ে পড়ে।’’ তাঁর দাবি, কয়েকটি ম্যাচে টানা নেতৃত্বদানে খুঁত খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু বাবরকে নিয়ে বোর্ড কিছু বলছে না।
বোর্ডের মুণ্ডপাত করেছেন শোয়েবও। বাবরের দল জ়িম্বাবোয়ের কাছে হেরে যাওয়ার পর তাঁর দাবি, দেশের ক্রিকেটকে উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের নেই। কটাক্ষ করে শোয়েব বলেন, ‘‘যেমন অধিনায়ক, তেমন দেশের ক্রিকেট বোর্ড, তেমনই ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান। কারও কোনও হেলদোল নেই!’’
সব ব্যাটারের জীবনে ব্যাড প্যাচ আসে। বিরাটের এসেছিল। বাবরের এসেছে। হয়তো তা কাটিয়েও উঠবেন শীঘ্রই। কিন্তু এই মুহূর্তে সমালোচনা বাঁধ মানছে না।
তবে ব্যাটার বাবরের চেয়ে অধিনায়ক বাবরের সমালোচনা হচ্ছে অনেক বেশি। যেমন প্রাক্তন অধিনায়ক সেলিম মালিক বলে দিলেন, বাবর না পারলে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিক।
সেলিম মালিকের কথায়, ‘‘বড় ম্যাচে বড় খেলোয়াড়দের অন্যদের চেয়ে বেশি চাপ নিতে হয়। তাঁদের ঘাড়ে বেশি দায়িত্ব থাকে। তাই এত বছর পরেও যদি এই পরিস্থিতিতে ঠিকঠাক অধিনায়কত্ব করতে না পারেন (বাবর), আমার মনে হয় ছেড়ে দেওয়া উচিত।’’
ভারতের কাছে হারের পর কেউ কেউ বলেছেন নওয়াজ় অধিনায়ক বাবরের আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। কিন্তু বাবর কেন স্পিনারের কোটা আগে শেষ করে শেষ ওভারের জন্য পেসারকে রাখলেন না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তনরা। প্রত্যেকের দাবি, এটা বাবরের বড় ভুল ছিল। এখন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ বাবর কবে এবং কী ভাবে ঘুরে দাঁড়ান, সেটাই দেখার।