আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে পাকিস্তান। নতুন সরকার গঠনের পরেও ছবিটা তেমন বদলায়নি। মানুষ খেতে পাচ্ছেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। শাহবাজ় শরিফের মাথার উপর ঝুলছে বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা। কিন্তু সরকারের কি তা নিয়ে আদৌ চিন্তা রয়েছে? আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেই পাক সরকার তাদের সামরিক শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে।
চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের সখ্য বহু পুরনো। চিনের থেকেই সাধারণত অস্ত্র কেনে পাকিস্তান। ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল, চিন প্রভাব বিস্তার করেছে এমন ৮২ দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের প্রযুক্তি, বিদেশনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে চিনের প্রভাব বেশি রয়েছে। চিন এবং পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক অংশীদারি গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পাকিস্তানে যা অস্ত্র আমদানি হয়েছে, তার ৮২ শতাংশই চিন থেকে গিয়েছে।
যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, ডুবোজাহাজ, ড্রোন ইত্যাদি পাকিস্তানকে সরবরাহ করেছে চিন, এমনই দাবি করা হয়েছিল ওই প্রতিবেদনে। পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে শক্তিশালী করতে চিনের অবদান নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য বৃদ্ধি করা কোয়াড-৪ (ভারত, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া) এবং পশ্চিমি শক্তিগুলির বিরুদ্ধে চিনের রণকৌশল বলেই মত অনেকের। গত এক দশকে বেজিং সেই নীতি অবলম্বন করেই বিশ্বের অন্য দেশগুলির কাছে নিজেকে জাহির করছে।
২০১৫ সালে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পাক সফরে গিয়েছিলেন। সে সময় পাকিস্তানের নৌশক্তি বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয় দু’দেশের মধ্যে। পাকিস্তান আটটি হ্যাঙ্গর শ্রেণির ডুবোজাহাজ নির্মাণের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে চিনের সঙ্গে।
শুধু ডুবোজাহাজ তৈরি নয়, তিন সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করতেও চিনকে পাশে পেয়েছে পাকিস্তান। আর্থিক সমস্যায় থাকা পাক সরকার উল্লেখযোগ্য ভাবে সামরিক খাতে অর্থ বৃদ্ধি করেছে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে শক্তিবৃদ্ধি করতে সামরিক বাহিনীকে উন্নত করার পথে হেঁটেছে পাক সরকার। ইসলামাবাদের গদিতে যিনিই বসেছেন, একই পন্থা নিয়েছেন।
২০২২ সালে আচমকাই আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। গত দু’বছর ধরে মূল্যবৃদ্ধির জন্য নাজেহাল অবস্থা পাক নাগরিকদের। খাবার নিয়ে সে দেশের মানুষকে প্রকাশ্য রাস্তায় মারপিটও করতে দেখা গিয়েছে একাধিক বার।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমার নাম নেই পাকিস্তানে। ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠছে পাকিস্তানের আমজনতার। আর্থিক সঙ্কট সামাল দিতে টালমাটাল অবস্থা তাদের।
২০২৩ সালে মূল্যবৃদ্ধির হার পৌঁছেছিল ৩৮ শতাংশে। সরকারি তথ্য বলছে, এক বছরের মধ্যে টম্যাটোর দাম বেড়েছিল ১৮৮ শতাংশ, পেঁয়াজ ৮৪ শতাংশ, মশলা ৪৯ শতাংশ, চিনি ৩৭ শতাংশ। আটা-ময়দার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হাহাকার করছে পাকিস্তানের আমজনতা।
কিন্তু কেন এই অবস্থা হল পাক অর্থনীতির? বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের উপর বিপুল ঋণের বোঝাই মূলত এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারও (আইএমএফ) পাকিস্তানকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে বেশ কিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছে। আইএমএফের শর্তের কারণে পাকিস্তান সরকার ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করেছে।
যার ফলে খাদ্যসামগ্রী থেকে মৌলিক চাহিদা, সব কিছুই ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে সে দেশে। গত বছর পাকিস্তানের বন্যাও খারাপ অবস্থার জন্য অনেকটা দায়ী।
দারিদ্রের সঙ্গে পাকিস্তানবাসীর ‘লড়াই’ নিয়ে কতটা চিন্তিত পাক সরকার? বিজ়নেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সম্প্রতি পাক সরকার প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় ১৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানের প্রকৃত ক্ষমতা পাক সেনার হাতেই রয়েছে! তাই বাজেটেও তাদের আধিপত্য।
সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য নিজের স্বার্থেই পাকিস্তানের হাত শক্ত করেছে চিন। বরাবরই ভারত-পাকিস্তানের বিরোধকে কাজে লাগিয়ে ফয়দা তুলতে চেয়েছে জিনপিং সরকার। কারণ ভারতের সঙ্গে চিনের ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলছে।
পাকিস্তানের পাশাপাশি চিনের সঙ্গেও সীমান্ত-বিরোধ রয়েছে ভারতের। দু’দেশের মধ্যে চাপা উত্তেজনা অনেক দিনের। এই আবহেই চিন-পাকিস্তানের বন্ধুত্ব। তবে পাকিস্তান যে ভাবে সামরিক শক্তিতে অর্থব্যয় করছে, তাতে সে দেশে আর্থিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞেরা।