‘সভ্য মানুষ’ তাঁকে চিড়িয়াখানায় রেখেছিল দীর্ঘ দিন। তাঁকে দেখানো হত মেলাতেও। কোনও দিন আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না বুঝতে পেরে যিনি আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তিনি ওটা বেঙ্গা। তার জীবনের গল্প শুনলে চোখে জল আসতে বাধ্য।
কে এই ওটা বেঙ্গা? যার জীবনকাহিনি ঔপনিবেশিক শোষণ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের উপর হওয়া অত্যাচারের অন্যতম নিদর্শন হয়ে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।
১৯০৪ সালের মার্চ মাস। কঙ্গো সেই সময় বেলজিয়ামের উপনিবেশ। ওটার বাড়ির এলাকায় আমেরিকার বাসিন্দা স্যামুয়েল ভার্নার ঘুরতে আসেন। ওটার বয়স তখন ১২ কি ১৩। ওটাকে তার বাড়ির কাছে থেকেই অপহরণ করেন স্যামুয়েল।
অপহরণ করার পর জাহাজে করে ওটাকে নিয়ে যাওয়া হয় নিউ অরলিয়্যান্সে। ওটার সঙ্গে সেই জাহাজে ছিল আফ্রিকার আরও আট জন কিশোর-যুবক। উদ্দেশ্য, ওই বছরের শেষের দিকে সেন্ট লুইসের ‘ওয়ার্ল্ড ফেয়ার’-এ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রদর্শনী করে টাকা কামানো।
শীতের শেষ পর্যন্ত চলেছিল ওই মেলা। কড়া ঠান্ডায় আফ্রিকা থেকে বন্দি করা ওই কিশোর-তরুণদের দলকে রাখা হয়েছিল পর্যাপ্ত গরম পোশাক বা আশ্রয় ছাড়াই। ঘুমোতে দেওয়া হয়েছিল মাটিতে। পর্যাপ্ত খাবারও দেওয়া হত না তাদের।
১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ওয়ার্ল্ড ফেয়ার’ থেকে নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয় ওটাকে। ২০ দিনের জন্য তাকে চিড়িয়াখানার খাঁচায় প্রদর্শনের জন্য রেখে দেওয়া হয়। ওটাকে দেখতে ভিড় উপচে পড়ে চিড়িয়াখানা চত্বরে।
ওটাকে ওই অবস্থায় দেখে অনেকেই ক্ষোভপ্রকাশ করেন। তার মুক্তির দাবিতে সরব হন অনেকে। বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন অনেকে।
জনগণের একাংশের ক্ষোভের মুখে প়ড়ে চিড়িয়াখানা থেকে মুক্তি দেওয়া হয় ওটাকে। চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়েও অবশ্য সম্পূর্ণ মুক্তি হয়নি তার। আফ্রিকান-আমেরিকান রেভারেন্ড জেমস এইচ গর্ডন পরিচালিত নিউ ইয়র্কের ‘হাওয়ার্ড কালারড অরফান’ মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে জায়গা হয় ওটার।
আমেরিকায় ওটা যাতে সমাজে ভাল ভাবে বাঁচতে পারে তাই তার দাঁত এবং জামাকাপড়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেন গর্ডন। ভাল জামাকাপড় কিনে দেওয়া হয় তাকে।
১৯১০ সালের জানুয়ারিতে ওটাকে ভার্জিনিয়ার লিঞ্চবার্গে ‘লিঞ্চবার্গ থিওলজিক্যাল সেমিনারি অ্যান্ড কলেজ’-এ পাঠিয়ে দেন গর্ডন। এই স্কুলে মূলত কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্ররাই পড়াশোনা করতেন।
লিঞ্চবার্গে ওটা হেইস পরিবারের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। গ্রেগরি ডব্লিউ হেইস ছিলেন এই পরিবারের মাথা। ওটাকে ভাল ভাবেই মেনে নিয়েছিল হেইস পরিবার।
স্কুলে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ওটার। কিশোর ওটা তখন তরুণ। সেখানে তিনি অন্যদের শেখাতেন, কী ভাবে শিকার করতে হয় এবং মাছ ধরতে হয়। এ ছাড়াও বাড়িতে থাকার সময় তিনি কী কী করতেন সেই গল্পও বন্ধুদের শোনাতেন ওটা।
লিঞ্চবার্গে স্থানীয় এক শিক্ষকের কাছে থেকে ওটার ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয়। কাজ চালানোর জন্য যথেষ্ট ইংরেজি শেখা হয়েছে ভেবে এক দিন হঠাৎই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য লিঞ্চবার্গের একটি তামাক কারখানায় কাজ শুরু করেন ওটা। তখন থেকেই তাঁর বাড়ি ফেরার চেষ্টার শুরু।
দীর্ঘ দিন বাড়ি ফেরার আশা নিয়ে থেকেও কোনও লাভ হয়নি ওটার। বিভিন্ন ভাবে কঙ্গো ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। কখনও টিকিটের দাম আবার কখনও অনুমতিপত্র, কিছু না কিছু তার বাড়ি ফেরার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে থাকে। ধীরে ধীরে হতাশা এবং বিষণ্ণতা গ্রাস করতে শুরু করে যুবক ওটাকে।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কঙ্গোর দিকে যাত্রিবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওটার কঙ্গো ফিরে যাওয়ার আশা আরও ক্ষীণ হতে থাকে।
১৯১৬ সাল। সারা বিশ্বে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহ। চারিদিকে গুলির আওয়াজ। বাতাসে বারুদের গন্ধ। এই অবস্থায় একটা বন্দুক জোগাড় করেন ওটা। ওই বছরেরই ২০ মার্চ নিজের কাছে লুকিয়ে রাখা বন্দুক দিয়ে বুকে গুলি করে আত্মঘাতী হন হতাশ, বিষণ্ণ ওটা। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ২৫ বছরের কাছাকাছি।
ওটার পালক পিতা গ্রেগরি হেইসের সমাধিস্থলের পাশে ওটাকে সমাধিস্থ করা হয়। রহস্যজনক ভাবে তাঁদের দু’জনেরই দেহাবশেষ এক দিন নিখোঁজ হয়ে যায়। যদিও স্থানীয়দের একাংশের মতে, গ্রেগরি এবং ওটার দেহাবশেষ ওই সমাধিক্ষেত্র থেকে সরিয়ে হোয়াইট রক হিল সমাধিক্ষেত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
ওটার মৃত্যুর পর তার জীবনকাহিনি লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিও আকর্ষণ করে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ওটাকে চিড়িয়াখানায় বন্দি রাখার ঘটনা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়।
যদিও চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তরফে ওটাকে বন্দি রাখার বিষয়টি বার বার অস্বীকার করা হয়েছে। উল্টে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, ওটা নাকি এক জন কর্মী হিসাবেই ওখানে কাজ করতেন।
ওটার মৃত্যুর ১০০ বছর পর, ২০২০ সালে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে তাঁকে বন্দি করার বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়। ওটার প্রতি অমানবিক ব্যবহারের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া হয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে।