এ বার শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ ছবি বয়কটের ডাক। কারণ একটি গানের দৃশ্যে নায়িকার বিকিনির রং। সেই রং গেরুয়া। তা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়েছেন দক্ষিণপন্থীরা। ছবি বয়কটের ডাক দিয়েছেন। ছবিটির শালীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ‘পাঠান’ একা নয়। প্রথমও নয়। এই তালিকা আরও দীর্ঘ।
ছবি বয়কটের ইতিহাসে একেবারে শুরুর দিকে রয়েছে ‘ফায়ার’। দীপা মেহতা পরিচালিত ছবিটি বয়কটের ডাক দিয়েছিল শিবসেনা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। মুম্বইয়ে দু’টি প্রেক্ষাগৃহে বন্ধ করা হয়েছিল ছবির সম্প্রচার। শিবসেনার সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন বেশ কিছু মহিলাও। তাঁদের দাবি ছিল, এ ভাবে আসলে ভারতীয় মহিলাদের মন নষ্ট করা হচ্ছে।
কী ছিল শাবানা আজমি আর নন্দিতা দাস অভিনীত সেই ছবির বিষয়? উত্তর, সমকামিতা। ছবিতে সমকামিতা দেখানোর কারণেই রোষের মুখে পড়েছিলেন পরিচালক। ছবির দুই মুখ্য চরিত্রের নাম ছিল রাধা আর সীতা, যাঁদের মধ্যে ছিল সমকামী সম্পর্ক। সেই নিয়েও তৈরি হয় বিতর্ক।
দীপা মেহতার আর একটি ছবি নিয়েও একই রকম বিতর্ক হয়েছিল। ‘ওয়াটার’। সে বারও বিক্ষোভ দেখিয়েছিল সেই শিবসেনা। ছবিটি ‘হিন্দু ধর্ম-বিরোধী’ বলে অভিযোগ করেছিল তারা। ২০০০ সালে ছবিটির শ্যুটিংয়ের সময় ভাঙচুর চালান বিক্ষোভকারীরা। ছবির সেট ভেঙে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে ভারত ছেড়ে শ্রীলঙ্কায় ছবির শ্যুটিং করেন দীপা।
ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৭ সালের মার্চে। বহু প্রেক্ষাগৃহ ছবিটি প্রদর্শনের সাহস দেখায়নি। যে সব প্রেক্ষাগৃহে ছবি মুক্তি পেয়েছিল, সেখানে হয়েছিল ভাঙচুর। কী এমন ছিল ‘ওয়াটার’ ছবিতে? ছবিতে হিন্দু বিধবাদের অবস্থা দেখানো হয়েছিল। সেখানে এক পুরোহিত বিধবাদের দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য করতেন। শিবসেনার দাবি ছিল, দেশে এখন বিধবাদের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
২০১৪ সালের ২ অক্টোবর মুক্তি পায় ‘হায়দর’। বিশাল ভরদ্বাজের এই ছবি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে সমাজমাধ্যমে। অভিযোগ করা হয়, ছবিটিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে খাটো করা হয়েছে। বরং পাকিস্তানকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমর্থন করেছে ছবিটি।
টুইটারে ‘বয়কট হায়দর’ হ্যাশট্যাগ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা দাবি করেন, ছবিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের লড়াই, ভোগান্তি নিয়ে কিছু দেখানো হয়নি। হিন্দু মন্দিরকে ‘শয়তানের ঘর’ বলে দেখানো হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।
২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর মুক্তি পায় আমির খানের ‘পিকে’। যোগগুরু রামদেব ছবিটি বয়কটের দাবি তোলেন। আমিরের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘বড় বড় ব্যক্তিত্বরা সম্ভবত হিন্দু দেব-দেবীকে অপমান করতে পছন্দ করেন।’’
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছবিটির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দলের সদস্যরাও প্রেক্ষাগৃহে ওই ছবি দেখানো বন্ধের দাবি তোলেন। ছবির পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেন।
দেশে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে বলে একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন আমির খান। জানিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী দেশ ছাড়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন। তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। ২০১৬ সালের ৪ জুলাই আমিরের ‘দঙ্গল’ ছবির পোস্টার মুক্তি পায়। সঙ্গে সঙ্গে ছবি বয়কটের ডাক দেওয়া হয় সমাজমাধ্যমে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমিরের কুশপুতুল পোড়ানো হয়।
সমাজমাধ্যমে কেউ কেউ আমিরকে ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থক’ বলে অভিহিত করেন। মাতৃভূমিকে ‘অসহিষ্ণু’ বলার জন্য অভিনেতার সমালোচনা করেন। এও দাবি ওঠে, লস্কর জঙ্গিদের সঙ্গে যোগ রয়েছে আমিরের। দাবির সমর্থনে একটি ছবিও প্রকাশ করা হয়। সেই ছবির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা’— এই ছবি নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কয়েক জন মুসলিম নেতা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবে ছবি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন তাঁরা। ওই মুসলিম নেতাদের দাবি ছিল, ছবিটি ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে।
অলঙ্কৃতা শ্রীবাস্তব পরিচালিত ছবিটি হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত করেছে বলেওদাবি তোলেন এক দল সমাজকর্মীও। সেন্সর বোর্ড (সিবিএফসি) ছবিটিকে শংসাপত্র দিতে অস্বীকার করে।
ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ওঠে সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর ছবি ‘পদ্মাবতী’-এর বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের ২৭ জানুয়ারি জয়পুরে ছবির সেটে ভাঙচুর চালায় রাজপুত করণী সেনা। দামি জিনিসপত্র ভাঙা হয়। পরিচালক সঞ্জয়ের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। করণী সেনার অভিযোগ ছিল, ছবিতে একটি দৃশ্য রয়েছে, যেখানে রানি পদ্মাবতীকে স্বপ্নে কামনা করছেন আলাউদ্দিন খিলজি। পদ্মাবতীর চরিত্রে ছিলেন দীপিকা পাড়ুকোন। আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রণবীর সিংহ।
পরে বিবৃতি দিয়ে সঞ্জয় জানান, ছবির বিষয় নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার পরই তা তৈরি করা হয়েছে। ইতিহাস বিকৃত করা হয়নি। ‘‘কারও ভাবাবেগে আঘাত করতে চাইনি।’’ এর পরেই সঞ্জয় বলেন, ‘‘আমি ঠিক রয়েছি। এ দেশে মাঝেমধ্যে ছবি তৈরি করতে গেলে এ ধরনের অপমান সহ্য করতে হয়।’’
‘ডার্লিংস’ ছবির একটি গান মুক্তি পায় গত অগস্টে। তার পরেও সমাজমাধ্যমে আলিয়া ভট্টকে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল, ছবিতে পুরুষদের নিগ্রহ করা হয়েছে। যথেষ্ট সম্মান করা হয়নি।
এক সাক্ষাৎকারে রণবীর সিংহ বলেছিলেন, তিনি গোমাংস খেতে পছন্দ করেন। সেই সাক্ষাৎকারকে হাতিয়ার করে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছবি বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের এক মন্দিরে ছবি মুক্তির আগে যাওয়ার কথা ছিল আলিয়া এবং রণবীরের। বিক্ষোভের মুখে পড়ে মন্দির যাত্রা বাতিল করেন তাঁরা।