ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে পূর্ব এশিয়ায়। এমনিতেই এই অঞ্চল দুই কোরিয়ার রেষারেষিতে অশান্ত থাকে। সাম্প্রতিক অশান্তির কেন্দ্রে উত্তর কোরিয়ার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র। গত মঙ্গলবার যে ক্ষেপণাস্ত্র জাপানের ভূখণ্ড পেরিয়ে গিয়ে পড়ে প্রশান্ত মহাসাগরে। দক্ষিণ কোরিয়ার তরফে জানানো হয়েছিল, মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে উত্তর কোরিয়া। কী এই ক্ষেপণাস্ত্রের বৈশিষ্ট্য? এই ঘটনার অভিঘাতই বা কী? দেখে নেওয়া যাক এক নজরে।
৪ অক্টোবর, মঙ্গলবার যে ক্ষেপণাস্ত্রটি ছুড়েছিল কিম জং উনের দেশ, সেটি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিমি পথ পার করে জাপানের উপর দিয়ে গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পড়েছে। এই প্রথম জাপানের উপর দিয়ে এত দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করল পিয়ংইয়ং।
ক্ষেপণাস্ত্রটির গতিপথ যদি অন্য হত, তা হলে প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে অবস্থিত আমেরিকার গুয়াম দ্বীপে সেটি হানা দিতে পারত বলে ধারণা। উত্তর কোরিয়া থেকে গুয়ামের দূরত্ব ৩ হাজার ৩৮০ কিলোমিটার।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, জাপানের উপর দিয়ে যে ক্ষেপণাস্ত্রটি নিক্ষেপ করেছে উত্তর কোরিয়া, সেটি মাঝারি পাল্লার ‘হাওয়াসং ১২’ ক্ষেপণাস্ত্র।
চলতি বছরে ৩০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে কিমের দেশ। যেগুলির মধ্যে রয়েছে ‘ব্যালিস্টিক মিসাইল’, ‘ক্রুজ মিসাইল’, ‘হাইপারসনিক মিসাইল’।
উত্তর কোরিয়ার স্বৈরাচারী শাসক কিমের হাতে রয়েছে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র। সেগুলির কোনওটা আবার দূরপাল্লার। ১০ হাজার কিমিরও বেশি দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারে কোনও ক্ষেপণাস্ত্র।
‘হাওয়াসং ১৪’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও পরীক্ষা করে উত্তর কোরিয়া। যেটি ৮ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারে। কোনও কোনও গবেষণায় আবার দাবি করা হয়েছে যে, এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত এগোতে পারে। এটি উত্তর কোরিয়ার প্রথম ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল’ (আইসিবিএম)।
তবে এর থেকেও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে পিয়ংইংয়ের হাতে। ‘হাওয়াসং ১৫’ ক্ষেপণাস্ত্রটি ১৩ হাজার কিমি পর্যন্ত গিয়ে হানা দিতে পারে।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রকাশ্যে এনেছিল উত্তর কোরিয়া। ওই ক্ষেপণাস্ত্রটির নাম ‘হাওয়াসং-১৭’। বলা হয়, এটি ১৫ হাজার কিমিরও বেশি দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারে।
এর আগে, ২০১৭ সালে জাপানের উপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল উত্তর কোরিয়া। পাঁচ বছর পর আবার জাপানের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে যে ভাবে উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল, তাতে ওই অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে পিয়ংইয়ং। উত্তর কোরিয়ার এ ধরনের আচরণ ‘বেপরোয়া’ বলে সরব হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। নিন্দায় সরব হয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তেনিও গুতারেজ।
মঙ্গলবার উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পরই বাসিন্দাদের সতর্ক করে দেয় জাপান। ট্রেন পরিষেবা সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল। এ ধরনের পদক্ষেপে একযোগে নিন্দায় সরব হয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতর্কিতে এ ধরনের অতর্কিতে মিসাইল হানার ফলে বিমান ও জাহাজের ক্ষতি হতে পারে। যে এলাকায় লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়, আগাম সতর্কতা না থাকলে বিমান ও জাহাজের জন্য তা বিপজ্জনক হতে পারে।
আবার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে গিয়ে গোলযোগ হলে, তা জনবহুল এলাকায় গিয়ে পড়তে পারে। যেমনটা হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে।
উত্তর কোরিয়ার ‘বদলা’ নিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকা। কিন্তু তার মধ্যে একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়াকে।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার গভীর রাতে (তারিখ অনুযায়ী বুধবার) ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল দক্ষিণ কোরিয়া। সে সময় একটি ক্ষেপণাস্ত্র দক্ষিণ কোরিয়ারই বায়ুসেনা ঘাঁটিতে আছড়ে পড়ে।
ওই বায়ুসেনা ঘাঁটিটির কাছেই রয়েছে গ্যাংনিউং শহর। ক্ষেপণাস্ত্রটি সেখানে পড়তেই বিকট আওয়াজ হয়। আগুনের ঝলকানিও দেখা যায়। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটেনি। এই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। তবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন শহরের বাসিন্দারা। এ জন্য পরে ক্ষমা চায় দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, স্বল্প পাল্লার ‘হিউমু-২ ব্যালিস্টিক’ ক্ষেপণাস্ত্রটি নিক্ষেপ করতে গিয়ে তা দক্ষিণ কোরিয়ার বায়ুসেনার ঘাঁটির মধ্যেই পড়ে। এই ঘটনার ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দুর্ঘটনার বিষয়টি নজরে আসে সে দেশের সেনার।
ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ঘিরে তিন দেশের মধ্যে পরিস্থিতি বেশ উত্তেজনাপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকা যৌথ ভাবে যে ভাবে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, তার জবাবে নতুন করে কোনও পদক্ষেপ করে কি না উত্তর কোরিয়া, এ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কিমের হাতে রয়েছে পরমাণু অস্ত্র। তাঁর খামখেয়ালি স্বভাবের কথা জানে আন্তর্জাতিক মহল। বার বার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জেরে আশঙ্কাই ছড়িয়েছে, আবার পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালাবে না তো উত্তর কোরিয়া?