প্রাচীন জার্মানির ছোট্ট শহর নর্ডলিঞ্জেন। ৮৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই শহরে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন যুগের নানা ঐতিহ্য বহন করছে নর্ডলিঞ্জেন।
শহর বলতে যে ছবি ভেসে ওঠে, নর্ডলিঞ্জেন ঠিক তেমন শহর নয়। একে কিছুটা মফস্সল বলা যায়। ইতিহাসের খনি লুকিয়ে আছে এই শহরে। ইতিহাসই শহরটিকে বিখ্যাত করে তুলেছে।
নর্ডলিঞ্জেন শহরের সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হল হিরে। মহামূল্যবান এই রত্ন বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মতো জার্মানির এই শহরে বিরল নয়। বরং এই শহরের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হিরে। যেন হিরে দিয়েই মুড়ে রাখা হয়েছে নর্ডলিঞ্জেন।
কোথা থেকে এল এই হিরে? ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী এবং প্রত্নতত্ত্ববিদরা গবেষণার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, এই শহরের উদ্ভব-রহস্য অনেক গভীর এবং চমকপ্রদ। দেড় কোটি বছরের পুরনো সেই রহস্যই হিরেতে মুড়েছে নর্ডলিঞ্জেনকে।
বিজ্ঞানীদের দাবি, আনুমানিক দেড় কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে উল্কাপাতের ফলে এই শহরের সৃষ্টি হয়েছে। বিশাল উল্কা এসে পড়েছিল জার্মানির এক প্রান্তে। তার ফলে বিশাল গর্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল সংশ্লিষ্ট এলাকায়।
ঘণ্টায় ৭০ হাজার কিলোমিটার বেগে ধেয়ে এসেছিল সেই উল্কাখণ্ড। উল্কাটি ২৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। সেই গর্তের উপরেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলেছে নর্ডলিঞ্জেন শহর।
দাবি, উল্কাপাতের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ‘সুয়েভাইত’ নামে নতুন এক প্রকার পাথরের সৃষ্টি হয়েছিল। স্ফটিক, কাচ এবং হিরে দিয়ে তৈরি সেই পাথর। শহর গড়ে ওঠে সুয়েভাইত পাথরেই।
হিরে সমন্বিত পাথর দিয়ে তৈরি হওয়ায় নর্ডলিঞ্জেন শহরে হিরের আধিক্য। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হিরে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে যে গির্জাটি রয়েছে, তা-ও তৈরি হয়েছে ওই পাথর দিয়েই।
সুয়েভাইত পাথরে তৈরি সেন্ট জর্জেস গির্জায় আনুমানিক ৫ হাজার ক্যারাট হিরে রয়েছে বলে দাবি করা হয়। গবেষকদের দাবি, সমগ্র নর্ডলিঞ্জেন শহরটিতে হিরের পরিমাণ আনুমানিক ৭২ হাজার টন।
তবে নর্ডলিঞ্জেনে ছড়িয়ে থাকা হিরে এতই সূক্ষ্ম যে, বাজারে তার মূল্য বেশি নয়। পাথরের সঙ্গে মিশে থাকায় হিরের অস্তিত্ব আলাদা করে খুঁজে পাওয়াও বেশ কঠিন।
শুধু হিরে নয়, আরও একটি কারণে বিখ্যাত জার্মানির বাভারিয়া প্রদেশের নর্ডলিঞ্জেন শহর। শোনা যায়, নর্ডলিঞ্জেন শহরে প্রাচীন কালে মানুষ নিরাপত্তার জন্য একটি পাঁচিল বানিয়েছিলেন। দেওয়াল তুলে দিয়েছিলেন শহরের চারদিকে। শহর ঘিরে রাখা সেই দেওয়াল আজও বর্তমান। সময় তার ক্ষয় করতে পারেনি। এতটুকুও আঁচ লাগেনি মধ্যযুগীয় দেওয়ালে।
কেন এত পুরনো দেওয়ালের গায়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনও আঁচ লাগল না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মত প্রচলিত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সেই রহস্য থেকে গিয়েছে অধরা। পর্যটক এবং স্থানীয় মানুষের কাছে বিস্ময় জাগায় নর্ডলিঞ্জেনের প্রাচীন প্রাচীর।
নর্ডলিঞ্জেন ছাড়াও জার্মানির আরও দুই শহরে এই ধরনের প্রাচীর রয়েছে। রথেনবার্গ এবং ডিঙ্কেলসবুল শহরে একই ভাবে সুরক্ষা-প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন প্রাচীন অধিবাসীরা। পুরনো সেই প্রাচীরও এখনও অক্ষত।
জার্মানিতে ঘুরতে গেলে পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র হিরের শহর নর্ডলিঞ্জেন। প্রকৃতির কোলে হিরের পাথরে তৈরি শহর দেখতে মুখিয়ে থাকেন পর্যটকরা।
নর্ডলিঞ্জেনের কাছেই রয়েছে অফনেট গুহা, যা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষী। প্রাচীন পাথরের যুগেও যে নর্ডলিঞ্জেনের অস্তিত্ব ছিল, এই গুহাই তার প্রমাণ।