যুদ্ধের কথা ভেবে তৈরি হয়েছিল বিশালাকার দুর্গ। তাতে কী ছিল না! সবই ছিল। কিন্তু যে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করবে ভেবে দুর্গ তৈরি হল, তারা আর আসেনি। সময়ের ফেরে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তৈরি দুর্গ এখন বিশালাকার হোটেল। যার অন্দরসজ্জা থেকে সুযোগ-সুবিধা, ১০ গোল দিতে পারে নামজাদা কোনও হোটেলকে। সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিস্তর ইতিহাস।
‘নো ম্যানস ল্যান্ড ফোর্ট’। সোলেন্ট স্ট্রেটের মাঝখানে নির্মিত এই দুর্গ তৈরি হয় ভিক্টোরিয়া আমলে। কারণ, ফরাসি আক্রমণের ভয়। সেই বহিরাক্রমণ থেকে ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথের দ্বীপ শহরকে রক্ষা করার জন্য ১৮৬৭ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে তৈরি হয় বিশাল এই দুর্গ। সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে যার দূরত্ব মেরেকেটে ২ ঘণ্টা।
ফরাসি আক্রমণ থেকে বাঁচতে সেই সময় তৈরি হয় মোট চারটি দুর্গ। বলাই বাহুল্য, দুর্গগুলো তৈরি করতে জলের মতো অর্থব্যয় হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং বিস্তৃত দুর্গের নাম পামারস্টোন। তারই অংশ নো ম্যানস্ ল্যান্ড, স্পিটব্যাঙ্ক দুর্গ, সেন্ট হেলেনস্ দুর্গ, হর্স স্যান্ড দুর্গ। এর অধিকাংশই সম্পূর্ণ তৈরি হওয়ার আগেই ভেঙে পড়ে। আর যে কাজের জন্য দুর্গগুলো তৈরি হয়, সেই কাজেও লাগেনি। কারণ, ফরাসিরা যে আক্রমণই করেনি! শুধু থেকে যায় নো ম্যানস ল্যান্ড দুর্গ।
তথ্য বলছে, নো ম্যানস ল্যান্ড তৈরি হয় ২০ বছর ধরে। সেই সময়ই খরচ পড়েছিল প্রায় ৪ লক্ষ ৬২ হাজার ৫০০ পাউন্ড। ২০০ ফুট একর জুড়ে এই নো ম্যানস ল্যান্ড সাজানো হয় কামান বোঝাই সাঁজোয়ায়। কৃত্রিম দ্বীপে ৪৯টি কামান এবং প্রচুর সেনার থাকার বন্দোবস্ত হয়।
বৃত্তাকার ওই দুর্গের মাঝখানে ডুবে যাওয়া একটি অংশ আছে। সেখান থেকে সমুদ্রতল থেকে পানযোগ্য জল সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। সৈন্যদের রাখতে যাবতীয় ব্যবস্থা এবং সুযোগ-সুবিধা ছিল। কিন্তু সবই আক্ষরিক ভাবে সমুদ্রের জলেই পড়েছিল। কাজে আসেনি। যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ডুবোজাহাজের আক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরক্ষা স্টেশন হিসাবে ব্যবহৃত হয় এই দুর্গ। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিমান আক্রমণের প্রতিরোধী হিসাবে কাজে লাগানো হয়।
কোনও কাজেই এই দুর্গ আসছে না দেখে ১৯৫০ সাল নাগাদ তাকে বাতিল হিসাবে চিহ্নিত করে দেয় ইংল্যান্ড। ১৯৬৩ সালে সে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সেটি বিক্রিও করে দেয়।
নব্বইয়ের দশকে বদলে যায় নো ম্যানস ল্যান্ড-এর রূপ। এক সময়ের যুদ্ধরোধী দুর্গ হয়ে যায় বিলাসবহুল হোটেল। যে হোটেলে রাখা হয় দুটো হেলিপ্যাড।
প্রথম দিকে দুর্গ-হোটেলে মোট ২১টি শোয়ার ঘর রাখা হয়। ছিল বিশাল ‘রুফ গার্ডেন’এবং ঝাঁ-চকচকে রেস্তরাঁ। দুর্গের নীচের অংশে তৈরি হয় বড় সুইমিং পুল। গরম জলে গা ভেজানোর বন্দোবস্ত হয়। আমোদ-প্রমোদের বিস্তর আয়োজন ছিল।
অভিনবত্ব আছে। জড়িয়ে আছে ইতিহাস। রয়েছে রাজকীয় সব বন্দোবস্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বিলাসবহুল হোটেল মোটেই চলেনি। ছুটি কাটানোর দারুণ সব উপকরণ এবং রাজকীয় ব্যবস্থা থাকলেও ইংল্যান্ডের ধনী ব্যক্তিদেরও সে ভাবে নজর কাড়েনি নো ম্যানস ল্যান্ড। এর ফলে সে ভাবে কখনও চালুও হয়নি হোটেলটি।
২০০৪ সাল নাগাদ নো ম্যানস ল্যান্ড দুর্গ কিনে নেন হরমেশ পুনী নামে এক ব্যবসায়ী। দাম পড়ে ৬০ লক্ষ পাউন্ড। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ওই দুর্গ-হোটেলকে বিশেষ উৎসবে ভাড়া খাটানোর। কিন্তু সে-ও আর হয়ে ওঠেনি। হোটেলের যে সুইমিং পুলটি ছিল, সেখান থেকে মারাত্মক দূষণ ছড়ায়। ফলে পুরো ব্যবসাটাই জলে যায়। এর পর ওই হোটেল বিক্রির কথা ভাবেন পুনী। দাম রাখা হয় ৪০ লক্ষ পাউন্ড। কিন্তু কেউই কেনার আগ্রহ দেখাননি। এ দিকে পাওনাদারদেরও চাপ বাড়ছিল।
আর্থিক সমস্যায় তখন বিধ্বস্ত পুনী। ব্যবসায় যে কয়েক জন বিনিয়োগকারী ছিলেন, তাঁরাও তখন চাপ দিচ্ছেন। কী করবেন, ভাবতে ভাবতে অকল্পনীয় এক কাজ করে বসলেন ওই ব্যবসায়ী। তিনি নিজেই বাক্স-প্যাঁটরা গুটিয়ে নিয়ে চলে এলেন নো ম্যানস ল্যান্ডে। সবগুলি চাবি রাখলেন নিজের কাছে। তার পর নিজেকেই সেই দুর্গের মধ্যে বন্দি করলেন। হোটেল যাতে হাতছাড়া না হয়, তাই এই ফন্দি।
২০০৮ সালে সংবাদমাধ্যমকে একটি সাক্ষাৎকার দেন ওই ব্যবসায়ী। তাতে তিনি দুর্গ-হোটেলের বেশ কিছু ছবি প্রকাশ্যে আনেন তিনি। কিন্তু তা দেখে অনেকেই হতাশ হন। দেখাশোনা আর পরিচর্যার অভাবে পুরো দুর্গের অবস্থা তখন খারাপ। মরা গাছ, ধুলোবালিতে ভরে যাওয়া আসবাবপত্র আর জল শুকিয়ে যাওয়া সুইমিং পুল দেখে কয়েকশো বছর পুরনো জমিদার বাড়ির তুলনা মনে আসবে।
ওই সময় ব্যবসায়ী পুনীর এক মন্তব্য খবরের শিরোনামে আসে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এই দুর্গ শুধু আমার। অন্য কারও বিক্রি করার অধিকার নেই। আর আমাকে যদি উচ্ছেদের আদেশ দেওয়া হয়, আদালতে লড়াই চালিয়ে যাব। আর একটি ব্যাপার হল, জেনেশুনে কেউ এটি কিনতে চাইবেন না। কারণ, তাতে তিনি বা তাঁরা আইনি ফাঁসে পড়বেন।’’
কিন্তু ওই সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরের বছর অর্থাৎ, ২০০৯ সালে অবশ্য দুর্গ থেকে পুনীকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। বিস্তর দর কষাকষির পর সম্প্রতি নো ম্যানস ল্যান্ড বিক্রি হয়েছে ন’লক্ষ ১০ হাজার পাউন্ডে। ১৫০ বছর আগে যে মূল্যে তৈরি হয়েছিল তার মাত্র দ্বিগুণ দামে। জিব্রাল্টারের একটি সংস্থা হয়ে যায় শতাব্দীপ্রাচীন দুর্গের মালিক।
ওই সংস্থা এই সম্পত্তি নিয়ে কী ভাবে কাজে লাগাবে, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে বেশ কিছু হেলিপ্যাড তৈরির খবর মিলেছে। ডক তৈরির আবেদন পুনর্নবীকরণ করেছে তারা। আপাতত এখানে বেড়াতেও যাওয়া যায়। ২০১৫ সালে দুর্গের আধুনিকীকরণ হয়েছে। এখন কোনও অনুষ্ঠান ভাড়া পাওয়া যায় এই দুর্গ। কর্পোরেট অফিসের মতো বড় হলঘর আছে সেখানে। রয়েছে ২২টি পেল্লাই শোয়ার ঘর। এ ছাড়া সি গলফ, ক্যাবারে বার, দোকান, রেস্তরাঁ রয়েছে। আছে পাব এবং নাইট ক্লাব, শপিং মল। আর হাওয়ায় রয়েছে নাটকীয় সব ইতিহাস।