গ্রহাণুর আঘাতেই পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় প্রাণী ডাইনোসর। প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে অবলুপ্ত হয়েছিল ডাইনোসর। এত দিন বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল ডাইনোসরেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর ওপর এক বিশাল গ্রহাণুর আঘাতের কারণে।
সেই ধারণায় এ বার বদল আসতে চলেছে। কারণ সম্প্রতি নতুন এক তথ্য হাতে এসেছে বিজ্ঞানীদের। এর ফলে পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে পূর্ববর্তী ডাইনোসর অবলুপ্তির তত্ত্ব।
নয়া গবেষণা বলছে এক নয়, একাধিক গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল পৃথিবীতে। যার ফলে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিশালাকার প্রাণীর অস্তিত্ব। পৃথিবীর বুকে এক সময় বিচরণ করত যে অতিকায় ডাইনোসরেরা, আজ শুধু পাওয়া যায় তাদের জীবাশ্ম।
গিনি উপকূলে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল আট কিমি ব্যাসের একটি বিশাল গর্ত। যা পরীক্ষা করে গবেষকেরা অনুমান করছেন এই গর্তটিও গ্রহাণু আছড়ে পড়ার ফলেই তৈরি হয়েছে। গভীর পাত্রের আকারের গর্তটি সিসমিক স্ক্যানের মাধ্যমে শনাক্ত করার পর বিজ্ঞানীদের ধারণা, যে গ্রহাণুকে ডাইনোসর অবলুপ্তির কারণ বলে ধরা হয়, তার সমসাময়িক এই গ্রহাণুটিও।
তাই বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা, একটি নয়, অন্তত দু’টি গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীতে হারিয়ে যায় গোটা একটা প্রজাতি। তবে এই দাবি প্রমাণিত হলে ডাইনোসর বিলুপ্তির স্বীকৃত তত্ত্ব পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
স্কটল্যান্ডের হেরিওট-ওয়াট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক ভূতত্ত্ববিদ উইসডিয়ান নিকোলসন ২০২২ সালে প্রথম এই গর্তটি আবিষ্কার করেন। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘নাদির ক্রেটার’। গ্রহাণুর আঘাতের ফলে যে গভীর গর্ত তৈরি হয় তার ইংরেজি নাম ‘ক্রেটার’।
তিনি বলেছিলেন, এই গর্তটি একটি ০.৪ কিমি ব্যাসের গ্রহাণুর সংঘর্ষেই সৃষ্ট, যা মেক্সিকোয় ‘চিকসুলুব ক্রেটার’ তৈরি করা গ্রহাণুর চেয়ে আকারে ছোট। এই ‘চিকসুলুব ক্রেটার’কেই ডাইনোসরদের পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে দায়ী করা হয়।
কী ঘটেছিল কোটি কোটি বছর আগে? একদল প্যালিয়েন্টোলজিস্টের মতে, পৃথিবীতে এক বিরাট গ্রহাণুর আঘাতের কারণে বিস্ফোরণ ঘটে। এর ফলে পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটে বিস্তর।
সেই পরিবেশের সঙ্গেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি ডাইনোসর প্রজাতি। সেই কারণেই সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বিশালাকার এই প্রাণী।
বিজ্ঞানীদের মতে, গ্রহাণুটি ছিল ১২ কিলোমিটার চওড়া। সেটা আছড়ে পড়েছিল মেক্সিকো উপসাগর তীরবর্তী ইউকাটান উপদ্বীপ এলাকায়। প্রবল গতিতে এটি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ার ফলে ২০০ কিলোমিটার চওড়া ও কয়েক কিলোমিটার গভীর গর্ত তৈরি হয়।
গর্তটির কিনারাগুলো ভিতরের দিকে ঢুকে যায়। সৃষ্টি হয়েছিল সুনামির। প্রবল জলোচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল। এই গর্তটির সমুদ্রের নীচে ডুবে থাকা বড় অংশ পরীক্ষা করে বি়জ্ঞানীরা তাতে জিপসামের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন।
জিপসামের অন্যতম উপাদান হল সালফার। বিজ্ঞানীদের মতে, সেই সালফার হয়তো গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে সমুদ্রে জলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সালফার বায়ুমণ্ডলে মিশে যাওয়ায় পৃথিবীর বেশির ভাগ স্থানের তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্য ডিগ্রির নীচে। ডাইনোসরদের বেঁচে থাকার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এই প্রতিকূল আবহাওয়াই।
নিকোলসনের নেতৃত্বে থাকা গবেষক দলটি বিশ্বাস করে যে, ‘নাদির ক্রেটার’ সৃষ্টিকারী গ্রহাণুটি প্রতি ঘণ্টায় ৭২ হাজার কিমির বেশি গতিতে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল। যার ফলে ভূমিধস সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের তলদেশেও পরিবর্তন ঘটে।
এই আঘাতের ফলে ভয়ঙ্কর সুনামি তৈরি হয়েছিল, যার উচ্চতা ৪০০ মিটারেরও বেশি বলে অনুমান করা হয়। এই সুনামি সম্ভবত আটলান্টিক মহাসাগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে দাবি করেছেন গবেষকেরা।
বিজ্ঞানীদের দাবি, ‘চিকসুলুব ক্রেটার’ তৈরি করা গ্রহাণুর চেয়ে আকারে ছোট হলেও দ্বিতীয় গ্রহাণুটির প্রভাব ছিল বেশি। দুই গ্রহাণুর সংঘর্ষের সম্মিলিত প্রভাবেই ডাইনোসর-সহ পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছিল বলে মনে করছে নতুন গবেষণা।
ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পর পৃথিবীতে শুরু হয় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যুগ।