কয়েক দশক ধরে মাটির নীচে ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন। অদূর ভবিষ্যতে তা নেভার কোনও সম্ভাবনাও নেই। পৃথিবীর বুকেই রয়েছে এমন একটি শহর, যা ৬০ বছর ধরে একটানা জ্বলছে।
আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার ছোট্ট শহর সেন্ট্রালিয়া। যদিও আজ গোটা শহর পরিত্যক্ত, ‘ভূতুড়ে’, প্রায় জনমানবহীন। মাটির নীচ থেকে ক্রমাগত বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে আসার ফলে মানুষ এই শহর ছেড়েছে।
সেন্ট্রালিয়ায় হাজার হাজার একর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কয়লা খনিগুলি প্রায় ৭০০ ফুট গভীর। এখানকার মানুষের আয়ের মূল উৎস ছিল শহরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কয়লা খনিগুলোই। আর তার মধ্যে বেশ কিছু খনি পরিত্যক্ত ছিল।
বিভীষিকার শুরু ১৯৬২ সালের মে মাসে। তবে সেন্ট্রালিয়ার আগুন জ্বলা কী ভাবে শুরু হয়েছিল তা কেউ জানে না। কেউ বলেন, ভুলবশত খনির মুখে আগুন লেগে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা শহরে।
জানা যায়, শহরে ‘স্মৃতি দিবস’ উদ্যাপনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া চলছিল। ঠিক হয়, উৎসব শুরুর আগে শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হবে। সে কারণে সব ময়লা-আবর্জনা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু কোনও রকম সাবধানতা না নিয়েই শহরের সমস্ত আবর্জনা জড়ো করে একটি বিশাল আগুন জ্বালানো হয়।
পুড়তে থাকা আবর্জনার জ্বলন্ত কণা বাতাসে উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই জ্বলন্ত কণাই কয়লাখনির পরিত্যক্ত শাখা দিয়ে ঢুকে কয়লাবোঝাই খনিতেও ছড়িয়ে যায়।
প্রথমে আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়লেও বাসিন্দারা প্রথমে কেউই খুব বেশি আতঙ্কিত হননি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এর পরই শহরবাসীর মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়তে শুরু করে।
আগুনের শিখা শহরের নীচে খনির অন্যান্য শাখাতেও ছড়িয়ে পড়ার কারণে শহরের ভিতরেও তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। কয়লার ধোঁয়া সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ায় আগুন নেভানোর কাজ কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি ক্রমে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।
কারও কারও বাড়ির বেসিনের পাইপ দিয়েও গরম ধোঁয়া বার হতে থাকে। প্রবল উত্তাপে শহরের রাস্তা ফেটে কয়লার ধোঁয়া বার হতে শুরু করে। যা আজও শেষ হয়নি।
শহরটি বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসে পূর্ণ হয়ে যায়। আতঙ্ক আর বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে শহরবাসী অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন।
এই ব্যাপক আগুন নেভাতে প্রচুর লোকবলের দরকার ছিল। প্রাথমিক ভাবে আগুন নেভাতে বড় বড় গর্ত খোঁড়া শুরু হলেও অর্থের অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। আগুন নেভানোর দ্বিতীয় পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। জল এবং ছোট পাথর দিয়ে গর্তগুলি ভরাট করার সেই চেষ্টাও বিফলে যায়। কারণ প্রবল শীতের কারণে জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল।
১৯৮৩ সাল নাগাদ পেনসিলভেনিয়া প্রশাসন আগুন নেভাতে ৫৮ কোটি টাকা খরচ করেছিল, কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। সেন্ট্রালিয়াকে বাঁচানোর চেষ্টা গত ৫০ বছরে বহু বার করা হলেও আগুনের আদি আর অন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
ক্রমাগত ধোঁয়ায় থাকার ফলে সেন্ট্রালিয়ার ঘরে ঘরে বাসিন্দারা অসুস্থ হতে থাকেন। মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে পশুপাখি। একই সঙ্গে চারপাশের গাছপালা শুকিয়ে যেতে থাকে। বছরের পর বছর জ্বলন্ত কয়লার উপরের মাটি আলগা হয়ে গিয়ে যখন-তখন ধস নামে বিভিন্ন এলাকায়।
১৯৮০ সাল নাগাদ শহরের জনসংখ্যা ছিল হাজারের কাছাকাছি। ১৯৮১ সালে ঘটে আরও মারাত্মক ঘটনা। বিষাক্ত গ্যাসের চাপে সরে গিয়ে একটি বাড়ির পিছনের উঠোনে বিশাল গর্ত তৈরি হয়ে যায়। টোড নামের ১২ বছরের এক বালক সেই মরণফাঁদে পড়ে যায়।
তার পর থেকেই সেন্ট্রালিয়া থেকে লোকজনকে স্থানান্তরিত করতে এবং সেখানকার বাড়িঘর ভেঙে ফেলতে শুরু করে পেনসিলভেনিয়া প্রশাসন।
১৯৯২ সালে পুরো শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সে দেশের সরকার। ১৯৯৩ সাল নাগাদ সেখানে মাত্র ৬৩ জন বাসিন্দা ছিলেন। ২০১৩ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা কমে ১০ জনে দাঁড়ায়।
সাধারণত মাটির নীচে থাকা কয়লাখনিতে আগুন জ্বলা বিরল কোনও ঘটনা নয়। পরিত্যক্ত খাদান থেকে নতুন সুড়ঙ্গ কেটে কয়লা তোলার কাজ চলতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মত, এই সব সুড়ঙ্গ দিয়ে অক্সিজেন ঢুকছে। আর অক্সিজেন পেয়ে মাটির ভিতরের কয়লা জ্বলছে।
সেন্ট্রালিয়ার আগুন এখন প্রায় ১৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়েছে ও ৩০০ ফুট গভীরে পৌঁছেছে। এখানকার পরিত্যক্ত সেই সব বসতিতে উঁকি মারলে হয়তো দেখা যাবে, ভাঙাচোরা দেওয়ালের ফাটল থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়েই যাচ্ছে।
সেন্ট্রালিয়া শহর আর এর আশপাশের পুরো এলাকা জুড়েই ছড়িয়ে আছে কয়লাখনির অসংখ্য শিরা-উপশিরা। কয়লাবোঝাই এই সুড়ঙ্গগুলোর কোনটিতে যে আগুন এখনও জ্বলছে, তা খুঁজে পাওয়া কার্যত অসম্ভব।
চারটি পৃথক শাখা প্রতি বছর প্রায় ৭৫ ফুট এগিয়ে চলেছে এবং শহরের নীচে এত বেশি কয়লা রয়েছে যে, আরও ২৫০ বছর ধরে জ্বলতে পারে সেন্ট্রালিয়া।