কৃষকের সন্তান হলেও চাষবাসে মন ছিল না। বরং আগ্রহ ছিল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে। তা নিয়ে উচ্চশিক্ষার পর টাটা গোষ্ঠীতে শিক্ষানবিশের কাজ জুটেছিল। আশির দশকে সেই চাকরির হাত ধরেই কর্মজীবনে সাফল্যের সূত্রপাত নটরাজন চন্দ্রশেখরনের। সে দিনের সেই কৃষকপুত্র আজ টাটা গোষ্ঠীর প্রাক্তন কর্ণধার রতন টাটার ডানহাত।
সংবাদমাধ্যম থেকে কর্পোরেট জগৎ— চন্দ্রশেখরনকে সকলেই চেনেন ‘চন্দ্র’ নামে। টাটা গোষ্ঠীর অন্যতম লাভজনক সংস্থা টাটা সন্সের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে যাওয়ার পর তাঁকে নাকি নিজের উত্তরসূরি বেছেছিলেন খোদ রতন টাটা। যদিও সরকারি ভাবে গোষ্ঠীর বোর্ড নিযু্ক্ত কমিটি চন্দ্রকে দায়িত্বভার দিয়েছিল।
১৯৬৩ সালে তামিলনাড়ুর মোহানুর গ্রামে জন্ম হয়েছিল চন্দ্রশেখরনের। কৃষক পরিবারের সন্তান চন্দ্রের পড়াশোনা হয়েছিল গ্রামেই একটি সরকারি স্কুলে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে তাঁর আগ্রহ দেখে চন্দ্রকে ভর্তি করানো হয়েছিল কোয়ম্বত্তূর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সে স্নাতক হন তিনি।
স্নাতক হওয়ার পর তিরুচিরাপল্লির রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনস (এমসিএ) নিয়ে পড়াশোনা করেন চন্দ্র। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হাসিলের পর শুরু হয় চাকরির সন্ধান।
টাটা গোষ্ঠীতে চন্দ্রের প্রবেশ ঘটেছিল আশির দশকের শেষ দিকে। ১৯৮৭ সালে টিসিএসে যোগ দেন তিনি। শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ পেলেও পরের দু’দশকে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উপরে উঠেছিলেন তিনি।
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে টিসিএসের বোর্ডে জায়গা পান চন্দ্র। এর দু’বছরের সংস্থার শীর্ষকর্তার চেয়ারে বসেন। ২০০৯ সালের অক্টোবরে টিসিএসের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) হিসাবে দায়িত্ব নেন চন্দ্র।
চন্দ্রের সাফল্যের কাহিনি এতেই থেমে থাকেনি। এস রামদোরাইয়ের অবসরের পর মাত্র ৪৬ বছর বয়সে টাটা গোষ্ঠীর সিইও হন তিনি। সেই সময় তিনিই ছিলেন ওই গোষ্ঠীর সর্বকনিষ্ঠ সিইও।
২০১৭ সালে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন চন্দ্র। তার আগের বছরের ২৪ অক্টোবর ওই পদ থেকে সরানো হয়েছিল সাইরাস মিস্ত্রিকে।
চন্দ্রই প্রথম ব্যক্তি যিনি পার্সি সম্প্রদায়ভুক্ত না হলেও প্রথম বার টাটা গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ পদে বসেছেন। সে সময় একটি সার্চ কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়েছিল চন্দ্রকে।
চন্দ্রের দূরদর্শিতার প্রমাণ মিলেছিল অচিরেই। টাটা গোষ্ঠীর সর্বেসর্বা হিসাবে তাঁর আমলেই গোষ্ঠীর মোট মুনাফা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। ২০১৭ সালে গোষ্ঠীর মোট মুনাফা ছিল ৩৬,৭২৮ কোটি টাকা। তবে ২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছিল ৬৪,২৬৭ কোটিতে।
গত ৫ বছরে টাটা গোষ্ঠীর রাজস্বও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে একটি পত্রিকার দাবি। ২০১৭ সালে তা ছিল ৬.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। তবে ২০২২ সালে ৯.৪৪ লক্ষ কোটির রাজস্ব আয় করে এই গোষ্ঠী।
শিক্ষানবিশের চাকরি থেকে টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষকর্তা হয়ে ওঠা চন্দ্রের আয় কত? সংবাদমাধ্যমের দাবি, চেয়ারম্যান হিসাবে ২০২১ -২২ অর্থবর্ষে চন্দ্রের বেতন ছিল ১০৯ কোটি টাকা। দিনে তাঁর আয় ৫৩ লক্ষ।
ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের কারণে নয়। ২০২০ সালে একটি বিলাসবহুল ডুপ্লে কিনে আবার শিরোনামে উঠে এলেছিলেন চন্দ্র। মুম্বইয়ের পেডার রোডে ওই ডুপ্লে-র জন্য তিনি ৯৮ কোটি খরচ করেছিলেন। ৬,০০০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের জন্য নাকি প্রতি মাসে ২০ লক্ষ টাকা খরচ করতেন চন্দ্র। শেষমেশ সেটি কিনে ফেলেন তিনি।
চলতি মাসে চন্দ্রকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র মুক্তি পেয়েছে। নেটফ্লিক্সের ‘ওয়ার্কিং: হোয়াট উই ডু অল ডে’ নামে ওই তথ্যচিত্রে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ঝলক দেখতে পাওয়া গিয়েছে। ওই তথ্যচিত্রে সঞ্চালকের ভূমিকায় রয়েছেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
নেটফ্লিক্সের ওই তথ্যচিত্রে চন্দ্র জানিয়েছেন, ছোটবেলায় এক বার বাবার সঙ্গে চাষবাসের কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। তবে সে সব করতে একেবারেই ভাল লাগছিল না। সে সময়ই স্থির করে ফেলেন, চাষবাস করবেন না তিনি। সে সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিল, তা আজ প্রমাণিত।