সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের গ্রহ। গ্রহ না বলে একে বামন গ্রহের পর্যায়ে ফেলারই পক্ষপাতী অনেকে। এক সময়ে সৌরজগতের কনিষ্ঠতম সদস্য বলে পরিচিত হলেও ২০০৬ সাল থেকে গ্রহের তকমা হারিয়েছে প্লুটো।
সূর্যের পরিবার থেকে ঠাঁইনাড়া হয়ে প্লুটোকে সরে যেতে হল অন্য পরিবারে। নেপচুনের পর যে বরফের সাম্রাজ্য রয়েছে তা ‘কুইপার বেল্ট’ নামে পরিচিত। সেই ঠান্ডা বরফের রাজ্যের অধিবাসী বলে দেগে দেওয়া হয় প্লুটোকে।
সৌরজগতের গ্রহগুলি গ্যাস ও ধুলোর যে চাকতি থেকে জন্ম নিয়েছিল, সেই চাকতির অবশিষ্ট অংশটি এখনও রয়েছে পৃথিবী থেকে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি কিলোমিটার দূরে। সেই বলয়ের মতো স্থানটি প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি কিলোমিটার বিস্তৃত। কুইপার বেল্ট হল ডোনাট আকৃতির একটি ঠান্ডা অঞ্চল, যা নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে থেকে সৌরজগতকে প্রদক্ষিণ করে।
এখানে গ্যাস আর ধুলোর ঘনত্ব এত কম ছিল যে, বড় কোনও গ্রহ জন্মাতে পারেনি। তাই এই জায়গাটি ছোট ছোট পাথর আর বরফের টুকরোয় ভরা। ঠিক মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝে গ্রহাণু বলয়ের মতো। প্রায় দু’দশক আগে, ১৯৯২ সালে এই ‘কুইপার বেল্ট’-এর হদিস পাওয়া যায়।
তখনই আবিষ্কার হয়, এই ‘কুইপার বেল্ট’-এর মধ্যেই অবস্থান করছে প্লুটো এবং সে ওই বেল্টের সবচেয়ে বড় সদস্য।
শুধু বামন গ্রহই নয়, তার যমজও রয়েছে এই বেল্টে। এই বামন গ্রহটির নাম শ্যারন দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ঘন অন্ধকার, হিমায়িত এই এলাকায় রয়েছে প্লুটোর মতো বেশ কয়েকটি টিএনও বা ‘ট্রান্স-নেপচুনিয়ান অবজেক্ট’। ‘ট্রান্স-নেপচুনিয়ান বস্তু’ হল সৌরজগতের যে কোনও ক্ষুদ্র গ্রহ, যা নেপচুনের চেয়ে বেশি গড় দূরত্বে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
প্লুটোকে এখন একটি টিএনও হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বলা ভাল, প্লুটোই ছিল মহাকাশবিজ্ঞানীদের আবিষ্কার করা প্রথম টিএনও।
‘কুইপার বেল্টে’ এই ধরনের আরও অনেক টিএনও এবং বামন গ্রহের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে পরবর্তী সময়ে। ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন ‘কুইপার বেল্ট’-এর সীমানার মধ্যে প্লুটোর চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি ভারী একটি গ্রহ আবিষ্কার করেন।
২০০৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ওই গ্রহটির নাম দেওয়া হয় ‘এরিস’। তার পরেই ‘আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান মণ্ডল’ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিয়ন’-এর সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, প্লুটোকে আর গ্রহ বলা যাবে না। এরিসকেও নয়। পরবর্তী কালে ‘হাউমিয়া’ এবং ‘মেকমেক’ নাম আরও দু’টি বামন গ্রহের সন্ধান পান মহাকাশ গবেষকেরা।
‘সেরেস’, ‘প্লুটো’, ‘এরিস’, ‘হাউমিয়া’ এবং ‘মাকিমাকি’ বহুলপরিচিত বামন গ্রহ। এর মধ্যে ‘সেরেস’ ছাড়া বাকি সবাই ‘কুইপার বেল্ট’-এর সদস্য। ভবিষ্যতে ‘কুইপার বেল্টে’ এই ধরনের আরও অনেক বামন গ্রহের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
২০২১ সালে মহাকাশে পাড়ি দেয় ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ হল এখন পর্যন্ত উৎক্ষেপিত সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে জটিল মহাকাশ টেলিস্কোপ। রাতের আঁধারে যে ভাবে ফুল পাপড়ি মেলে, সে ভাবেই মহাকাশে এই টেলিস্কোপের ১৮টি ষড়ভুজ আয়না খোলে।
নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এ পর্যন্ত বিশ্বের আধুনিকতম দূরবীক্ষণ যন্ত্র। তার পূর্বসূরি হাব্ল টেলিস্কোপের চেয়ে বহু গুণ শক্তিশালী। সেই টেলিস্কোপেই ধরা পড়েছে টিএনওগুলির পৃষ্ঠের ছবি। শক্তিশালী ক্যামেরা প্রাথমিক পর্বে যে সব ছবি পৃথিবীতে পাঠিয়েছে, তা নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে নতুন নতুন তথ্য।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের নিয়ার ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ যন্ত্রে ধরা পড়েছে টিএনওগুলির বরফ-কঠিন শরীর। আলোক বর্ণালির সাহায্যে একটি লেখচিত্র তৈরি করে তা থেকে এদের তাপমাত্রা, ভর এবং রাসায়নিক গঠন প্রকাশ করেছে টেলিস্কোপটি।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি থেকে প্রায় ১ থেকে ৫ মাইক্রন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকগুলি বেরিয়ে শত শত বা হাজার হাজার পৃথক রঙে বিভক্ত হয়ে যায়। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই রংগুলির আপেক্ষিক উজ্জ্বলতা হল একটি বর্ণালি। বিভিন্ন পদার্থের উপর সেই আলো পড়লে তা থেকে বিভিন্ন বর্ণালি দেখা যায়। এগুলিকে পর্যবেক্ষণ করে সেই বস্তুর গঠন শনাক্ত করতে সহায়তা করে টেলিস্কোপের নিয়ার ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ যন্ত্রটি।
এখানে নানা রকমের বরফ রয়েছে। নাইট্রোজেন বরফ, কার্বন মনোক্সাইড বরফ, মিথেন বরফ। একই সঙ্গে রয়েছে জলের বরফও। সৌরমণ্ডলের সুদূর টিএনওগুলিকে দূর থেকেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন মহাকাশবিজ্ঞানীরা। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটির পাঠানো ছবির দৌলতে প্লুটো-সহ বামন গ্রহগুলি এখন যেন পৃথিবীর প্রতিবেশী।
বিজ্ঞানীরা ৭৫টিরও বেশি ট্রান্স-নেপচুনিয়ান বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন। নেপচুনের ও পারে থাকা রহস্যময় টিএনওগুলির অন্দরমহলের ছবি হাতে আসার পর বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ বলছে, এই সব তৈরি হয়েছে নাইট্রোজেন বরফ, কার্বন মনোক্সাইড বরফ আর মিথেন বরফের সমাহারে।
এগুলি তৈরি হয়েছে এমন অণুর দ্বারা, যার মধ্যে রয়েছে জল, কার্বন ডাই অক্সাইড বরফ এবং সিলিকেট-সমৃদ্ধ ধুলো। সূর্যের চেয়ে অনেক অনেক দূরে থাকায় অসম্ভব ঠান্ডায় সেই নাইট্রোজেন আর তরল বা গ্যাসীয় অবস্থায় থাকতে পারেনি। জমে পুরু ও শক্ত বরফ হয়ে গিয়েছে।