মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শুল্কযুদ্ধে চিনের ভরসা মাও জে দং! ৪৯ বছর পর কবর খুঁড়ে প্রয়াত কিংবদন্তি চেয়ারম্যানকে ‘জীবন্ত’ করল ড্রাগন। প্রকাশ্যে এনেছে কোরিয়া যুদ্ধের প্রসঙ্গ। বেজিঙের এ হেন পদক্ষেপ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জের শামিল বলেই মনে করা হচ্ছে। আমেরিকা একে হুমকি হিসাবে নিলে দুই দেশের মধ্যে যে সংঘাত তীব্র হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কমিউনিস্ট চিনের রূপকার ছিলেন কিংবদন্তি মাও। তার আমলে আমেরিকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় ড্রাগনের লালফৌজ। লড়াইয়ের সময়কার মাওয়ের একটি ভিডিয়ো সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে চিনা সমাজমাধ্যমে। সেখানে দেশটির প্রথম চেয়ারম্যানের গলায় ছিল ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে হুমকির সুর।
ইতিহাসবিদদের দাবি, মাওয়ের ওই ভিডিয়োটি ১৯৫৩ সালের। সে সময়ে পুরোদমে চলছে কোরীয় যুদ্ধ। উত্তর কোরিয়ার হয়ে রণাঙ্গনে নামে চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। অন্য দিকে, দক্ষিণ কোরিয়াকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিল মার্কিন ফৌজ। দু’পক্ষের তুমুল লড়াই যখন ভয়াবহ আকার নিয়েছে, ঠিক তখনই ‘শেষ দেখে ছাড়ব’ বলে হুঙ্কার দেন মাও। ৭২ বছর পর তাঁর করা সেই মন্তব্য সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
কোরীয় যুদ্ধ চলাকালীন ওই ভিডিয়োটিতে ঠিক কী মন্তব্য করেছিলেন মাও? সেখানে তৎকালীন দু’জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম নিয়ে হুঁশিয়ারি দিতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। মাও বলেছিলেন, ‘‘এই যুদ্ধ যত দিন চলুক না কেন, আমরা কখনওই নতি স্বীকার করব না। সম্পূর্ণ ভাবে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে চিন।’’
এর পরই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন মাও। চিনের প্রথম চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘‘এই যুদ্ধ কত দিন চলবে সেটা আমরা নির্ধারণ করতে পারি না। আগে এটা ট্রুম্যানের (৩৩তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান) উপর নির্ভর করছিল। এ বার আইজ়েনহাওয়ার (৩৪তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজ়েনহাওয়ার) বা আমেরিকার পরবর্তী কোনও প্রেসিডেন্ট ঠিক করবেন।’’
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধের মধ্যে ভাইরাল হওয়া মাওয়ের ভিডিয়োটিকে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) পোস্ট করেন বেজিঙের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং। নীচে তিনি লেখেন, ‘‘উস্কানিতে কখনওই ভীত নয় চিন। আমরা কখনওই পিছু হটব না।’’
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে, পরাজিত জাপানি উপনিবেশ কোরীয় উপদ্বীপকে দু’টি অংশে ভাগ করা হয়। উত্তর দিকের এলাকার উপর প্রভাব ছিল রাশিয়া তথা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের। আর দক্ষিণ অংশ ঝুঁকে ছিল আমেরিকার দিকে। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত বিরোধ বাড়তে শুরু করে।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ঙে কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন কিম ইল সুং। অন্য দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোলে তৈরি হয় উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সরকার। এর নেতৃত্বে ছিলেন সিঙ্গম্যান রি। দু’টি সরকারই সমগ্র উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের বলে দাবি করতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের উস্কানি। শুধু তাই নয়, দুই কোরিয়ার বাহিনীর মধ্যে সীমান্ত সংঘাত লেগেই থাকত।
১৯৫০ সালের ২৫ জুন পিয়ংইয়ঙের ‘কোরিয়ান পিপল্স আর্মি’ (কেপিআর) আচমকা সোল আক্রমণ করলে কোরীয় যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। লড়াইয়ে নামার আগে সোভিয়েতের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল উত্তর কোরিয়ার বাহিনী। এ ছাড়া মস্কোর দেওয়া অত্যাধুনিক হাতিয়ারও ছিল কেপিআরের অফিসার এবং জওয়ানদের কাছে।
এই যুদ্ধের কড়া নিন্দা করে আক্রমণ প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রপুঞ্জ। সোভিয়েত প্রতিনিধির অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে সেই প্রস্তাব পাশ করিয়েছিল আমেরিকা। এর পর ২১টি দেশকে সঙ্গে নিয়ে সোল রক্ষায় পুরোদস্তুর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়াশিংটন। রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই যৌথ বাহিনীর ৯০ শতাংশ সৈনিক এবং অফিসারেরা ছিলেন মার্কিন নাগরিক।
কোরীয় যুদ্ধের প্রথম দিকে অবশ্য এতে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি চিন। ১৯৫০ সালের ২৮ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনীর হাতে সোলের পতন হয়। উপদ্বীপের দক্ষিণাংশের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছিল কেপিআর। কিন্তু ১৫ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের যৌথ বাহিনী সোলের কাছে ইনচনে অবতরণ করলে ঘুরে যায় পরিস্থিতি। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে পিয়ংইয়ং দখল করে নেয় তারা।
উত্তর কোরিয়ার রাজধানী দখলের পর চিন সীমান্তের ইয়ালু নদীর দিকে অগ্রসর হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের যৌথ বাহিনী। প্রমাদ গোনেন চেয়ারম্যান মাও। ওই সময়ে কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার পাশে দাঁড়াতে ‘পিপল্স ভলেন্টিয়ার্স আর্মি’ (পিভিএ) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। নিন্দকদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ধুলো দিতে ড্রাগনের সরকারি বাহিনী পিএলএ-র গর্ভ থেকেই পিভিএ-র জন্ম দিয়েছিলেন সুচতুর মাও।
কোরীয় যুদ্ধের সময়ে ইয়ালু টপকে রাষ্ট্রপুঞ্জের যৌথ বাহিনীর উপর দু’বার আক্রমণ শানিয়েছিল ড্রাগনের পিভিএ। ফলে বাধ্য হয়ে পিছু হটে তারা। এই সুযোগকে কাছে লাগিয়ে ফের সোল দখল করে উত্তর কোরিয়ার বাহিনী। যদিও সেই জয় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অচিরেই সোল পুনরুদ্ধার করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রপুঞ্জের বাহিনী। এই প্রত্যাঘাতে পিভিএ-র একরকম কোমর ভেঙে গিয়েছিল।
১৯৫১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে হোয়েংসং এবং চিপিয়ং-নির যুদ্ধে পিভিএ-র পরিণতি ছিল খুবই করুণ। ওই সময়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন ধুরন্ধর মার্কিন সেনা ম্যাথিউ রিডগওয়ে। দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার লড়াইয়ে নামার আগেই পিভিএ-র হাতিয়ার ও রসদের যাবতীয় সরবরাহ লাইনকে যুদ্ধবিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে উড়িয়ে দেন তিনি। এর ফলে যৌথ বাহিনীর প্রত্যাঘাত সহ্য করার মতো ক্ষমতা আর তাদের ছিল না।
সূত্রের খবর, হোয়েংসং এবং চিপিয়ং-নির যুদ্ধে পিভিএ-র নিহত সৈনিকের সংখ্যা ছিল ৮০ থেকে ৯০ হাজার। অন্য দিকে যৌথ বাহিনীর ১৫ হাজার ৭৬৯ জন সেনার প্রাণ গিয়েছিল। এই লড়াইয়ের কিছু দিন পর যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় বসে দু’পক্ষ। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই এই সংক্রান্ত চুক্তি সই হলে বন্ধ হয় দুই কোরিয়ার সংঘর্ষ।
গত শতাব্দীতে সোভিয়েত ও আমেরিকার মধ্যে চলা ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ছিল কোরীয় যুদ্ধ। এটি শুরুর সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ট্রুম্যান। আর যখন সংঘর্ষ বন্ধ হচ্ছে, তখন ওয়াশিংটনের কুর্সিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের রণাঙ্গনে নায়কের সম্মান পাওয়া সাবেক সেনা অফিসার আইজ়েনহাওয়ার। প্রশান্ত মহাসাগরের উপদ্বীপে তাঁদের দাবার চালে চেয়ারম্যান মাও কতটা বিপাকে পড়েছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক বিস্তর।
দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ থামার সাত দশক পর ফের এক বার আমেরিকা ও চিনের মুখোমুখি হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি। বেজিঙের আমদানি পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি। পাল্টা মার্কিন সামগ্রীতে ১২৫ শতাংশ কর বসিয়ে কড়া বার্তা দিয়েছে বেজিং।
১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মাও। জীবদ্দশায় সব সময় ‘সাম্রাজ্যবাদী’ আমেরিকার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে লড়াই চালানোর কথা বলতেন তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই নীতিকে আঁকড়ে ধরে ওয়াশিংটনকে বার বার বার্তা দিয়েছে বেজিং। তবে এই বাণিজ্য সংঘাতে মাওয়ের উত্তরসূরি তথা বর্তমান চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং শেষ হাসি হাসবেন কি না, তার উত্তর দেবে সময়।