২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সপরিবার খুন করা হয় বলিউড অভিনেত্রী লায়লা খান ওরফে রেশমা পটেলকে। ইগাদপুরী বাগানবাড়িতে ছুটি কাটানোর সময় খুন হন লায়লা। বলিউডের এক কালের সুপারস্টার রাজেশ খন্নার বিপরীতে একটি সিনেমায় অভিনয় করে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন লায়লা। তাঁর রূপের জাদুতে মোহিত হয়েছিলেন অনেকেই। লায়লার জন্ম পাকিস্তানে হলেও পরে তাঁরা সপরিবার ভারতে চলে আসেন।
খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন মূল অভিযুক্ত তথা লায়লার মা সেলিনা খানের তৃতীয় স্বামী পারভেজ ইকবাল তক। অভিযোগ আনা হয়, রাগের মাথায় পরিবারের সব সদস্যকে খুন করেন পারভেজ।
পারভেজ পুলিশকে জানিয়েছিলেন, দ্বিতীয় স্বামী আসিফ শেখের সঙ্গে সেলিনার ঘনিষ্ঠতা তাঁর অপছন্দ ছিল। তবে সম্পত্তির লোভেই এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়নি পুলিশ। পরে এই ঘটনায় সম্পত্তি হাতানোর কারণকেও খুনের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরে নেয় পুলিশ।
তবে সত্যিই কি শুধু সম্পত্তির জন্য খুন না ভিতরে আরও কোনও জটিল রহস্য লুকিয়ে ছিল এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে?
সেই সময় মুম্বইয়ের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার হিমাংশু রায় জানিয়েছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় পারভেজ বয়ান দেন, লায়লার পুরো পরিবার তাঁকে ছেড়ে দুবাই চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সেই কারণেই তিনি মনের দুঃখে সবাইকে মেরে ফেলেন।
লায়লার বাবা তথা সেলিনার প্রথম স্বামী নাদিরশাহ পটেলই প্রথম পুলিশের কাছে গিয়ে লায়লা এবং তাঁর মা সেলিনা-সহ পরিবারের ছয় সদস্যের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়েছেন। সেলিনা (৫৯), তাঁর বড় মেয়ে আজমিনা পটেল (৩২), মেজ মেয়ে লায়লা (৩০), যমজ সন্তান জারা এবং ইমরান (২৫), এবং আরেক জন আত্মীয় রেশমা সাগির খান (১৯) রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যান।
এর পর জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ কিশতওয়ারে প্রধান অভিযুক্ত পারভেজকে অন্য একটি মামলায় গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে মামলাটি মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চে স্থানান্তরিত করা হয়।
এর এক সপ্তাহ পরে মুম্বই পুলিশের একটি দল, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে ইগাদপুরী বাগানবাড়ি থেকে পাঁচ মহিলা এবং এক পুরুষের মোট ছ’টি কঙ্কাল খুঁজে বের করে। কঙ্কাল পুঁতে রাখার ঘটনাস্থল চিনিয়ে দেন অভিযুক্ত পারভেজই। কঙ্কালের সংখ্যার সঙ্গে নিখোঁজদের সংখ্যার মিল অঙ্কের অনেকটা হিসেবই মিলিয়ে দেয়।
কঙ্কালগুলির ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। তবে এর মধ্যে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল পুরুষ কঙ্কালের খুলি। এই কঙ্কালের খুলি আঘাতের জেরে প্রায় দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল।
পুলিশ তদন্ত করার সময় জানতে পারে, ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে মৃতদের পরিবারের সকল সদস্য খাওয়াদাওয়া করছিলেন। এর পর তাঁরা সকলেই মধ্যরাত অবধি নাচ-গান করে উল্লাসে মাতেন। রাত ১টা নাগাদ তাঁরা বাড়ির দোতলায় যে যার ঘরে ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময়েই সেলিনা ও পারভেজের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি শুরু হয়।
চিৎকার শুনে দু’তলা থেকে এক তলায় নেমে আসেন সকলে। তখনই সকলের সামনেই একটি ভারী ভোঁতা জিনিস দিয়ে সেলিনার মাথায় আঘাত করেন পারভেজ। তৎক্ষণাৎ মারা যান সেলিনা।
এর পর উপস্থিত সকলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলে তাঁদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয় পারভেজের। এরই মধ্যে পারভেজ শাকির হুসেনকে ডাক দেন। শাকিরকে বাগানবাড়ি দেখভালের জন্য কাশ্মীর থেকে নিয়ে এসেছিলেন পারভেজ। এর পর তাঁরা দু’জন মিলে পুরো পরিবারকে খুন করেন।
এর পর বাগানবাড়ির প্রাঙ্গণে একটি গর্ত করে মৃতদেহগুলি চাপা দিয়ে দেয় অভিযুক্তেরা। কিছু গয়না, একটি লোহার রড এবং রক্তের দাগ-সহ দু’টি ছুরিও ওই জায়গায় পুঁতে দেন তাঁরা। কঙ্কাল উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ এই সরঞ্জামগুলিও উদ্ধার করে।
পুলিশের কাছে পারভেজের দেওয়া বয়ান অনুযায়ী, তিনি এবং সেলিনা ২০০৯ সাল থেকে এক সঙ্গে বসবাস করতেন। বিয়ে হয়েছিল আগেই। ২০১১-এর ২ ফেব্রুয়ারি লায়লা-সহ তাঁদের পরিবারের সকলে ইগদপুরীর বাগানবা়ড়িতে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে পারভেজ জানতে পারেন যে, লায়লা এবং সেলিনা-সহ তাঁদের পরিবারের সকলে দুবাই যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তবে তাঁকে এই বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
হত্যাকাণ্ডের দিন রাতে দুবাই যাওয়া এবং সেলিনার সঙ্গে তাঁর প্রাক্তন স্বামী আসিফের ঘনিষ্ঠতা, এই দুই বিষয়ে সেলিনা এবং পারভেজের তুমুল কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এর পরই রাগের মাথায় সকলকে খুন করেন তিনি এবং তাঁর সহযোগী শাকির।
হত্যার পর পারভেজ এবং শাকির ইগাদপুরী থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে এক জায়গায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে লায়লাদের ওশিওয়ারার ফ্ল্যাটে যান তাঁরা। সেখানে টাকাপয়সা এবং মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ি করে কাশ্মীরে চলে যান।
এই ঘটনা শুধুমাত্র স্ত্রীর সঙ্গে প্রাক্তন স্বামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সম্পত্তির জন্য করা হয়েছে, তা সহজে মেনে নেয়নি পুলিশ। শুরু হয় আরও তদন্ত।
সেই সময়ের কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে না কি অপরাধ-জগতের যোগ থাকলেও থাকতে পারে। আর তা নিছকই জল্পনা ছিল না। এর পিছনে ছিল নির্দিষ্ট কিছু তথ্য।
মনে করা হচ্ছিল, লায়লার সঙ্গে দুবাইয়ের কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির বিয়ে হয়েছিল। আর সেই ব্যক্তির ইচ্ছেতেই না কি লায়লা পুরো পরিবারকে নিয়ে দুবাই চলে যাচ্ছিলেন। তবে এই তালিকায় ছিল না পারভেজের নাম। এ-ও হয়তো সেই প্রভাবশালী ব্যক্তির ইচ্ছেতেই। কিন্তু কে ছিলেন সেই প্রভাবশালী ব্যক্তি, তা কখনও সামনে আসেনি।
আরও জল্পনা ছিল, নিষিদ্ধ বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ আল-ইসলামির সদস্য মুনির খানের সঙ্গে বিয়ে হয় লায়লার। লায়লার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, লায়লা জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইবা (এলইটি)-কে মুম্বই সংক্রান্ত অনেক তথ্য সরবরাহ করেছিলেন। এই সব তথ্য দিয়ে এই জঙ্গি সংগঠন মুম্বইয়ের বুকে নাশকতার ছক কষছিল। তবে পরে না কি তিনি এই তথ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন।
পাশাপাশি মনে করা হয়েছিল, অভিযুক্ত পারভেজ নিজে লস্কর-ই-তইবার সদস্য ছিলেন। এবং তাঁর মাধ্যমেই লায়লা বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করতেন। জল্পনা উঠেছিল, লায়লা তথ্য সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতেই পারভেজ তাঁকে মারার সিদ্ধান্ত নেন। আসলে সেলিনা নন, পারভেজের আসল লক্ষ্য ছিলেন লায়লা। এবং এই হত্যাকাণ্ড থেকে জঙ্গি-যোগকে দূরে রাখতেই তিনি খুন করার কারণ হিসেবে গল্প ফেঁদেছিলেন। তাঁর কাছে না কি এমনটাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল উপরমহল থেকে।
তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে এমন কোনও তথ্য উঠে আসেনি, যার থেকে প্রমাণ করা যায় যে এই ঘটনায় জঙ্গি যোগ ছিল। ২০১১ সালেই শেষ হয়ে যায় বলিউডের উঠতি নায়িকা লায়লার কাহিনি।