কথায় আছে অপরাধী কোনও অপরাধ করার পর কোনও না কোনও প্রমাণ ছেড়ে রেখে যায়। কিন্তু কখনও কখনও অপরাধ এতটাই সুপরিকল্পিত ভাবে করা হয় যে, কিনারা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তদন্তকারীদের।
আমাদের দেশে এমন বহু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। এবং অনেক চেষ্টা করেও অপরাধীকে ধরা যায়নি। ফলে খুনি কে, তা নিয়ে রহস্য থেকে গিয়েছে। এই রকমই কিছু রহস্যের কথা নীচে তুলে ধরা হল।
প্রথমেই উল্লেখ করা যাক, অমর সিংহ চামকিলা এবং তাঁর স্ত্রী অমরজ্যোৎ কৌর হত্যাকাণ্ডের কথা। এই ভয়ডরহীন গায়ক দম্পতিকে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে খুন করে বন্দুকধারী দুষ্কৃতীরা। কিন্তু কেন?
অমর ছিলেন পঞ্জাবি সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তি এবং পঞ্জাবের সর্বকালের সেরা গায়কদের অন্যতম হিসাবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। তাঁর মৃত্যু আজও রহস্য।
গ্রাম্যজীবন নিয়েই গান লিখতেন অমর সিংহ। তাঁর গানের বাণীতে থাকত মাদকের নেশা, মদের নেশা, পরকীয়া ইত্যাদি সামাজিক বিষয় নিয়ে নানা সমস্যার কথা। সত্যি কথা বলার জন্য তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল অনুগামীদের মধ্যে। যার জন্য তিনি নিন্দকদের চক্ষুশূলও হয়েছিলেন।
কর্মজীবনে সাফল্যের তুঙ্গে থাকাকালীন তাঁকে বেশ কয়েক বার খলিস্তানপন্থীদের তরফ থেকে হুমকি দেওয়া হয়। যার অন্যতম কারণ, তাঁর গানের বাণী। অপর কারণ, তাঁর স্ত্রী অমরজ্যোৎ কৌর। অমরজ্যোৎ ছিলেন ভিন্ন জাতের। দু’জনে একসঙ্গে মঞ্চে গান গাইতেন।
১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ। পঞ্জাবের মেহসামপুরে এক অনুষ্ঠানে চলেছেন সস্ত্রীক অমর। এক জায়গায় গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে অমর নামার সময় মোটর বাইকে এসে কয়েক জন বন্দুকধারী দুষ্কৃতী তাঁদের ঘিরে ধরল। এর পর প্রকাশ্যেই তাঁদের লক্ষ্য করে চলল গুলি। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় অমরজ্যোৎ এবং তাঁর স্বামীর। সে সময় অমরজ্যোৎ চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
ঘটনার দায় জঙ্গিদের উপর চাপানো হয়। কিন্তু অনেকে মনে করেন, পঞ্জাবের অন্য গায়করা ষড়যন্ত্র করে অমর এবং তাঁর স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন। ঘটনার জেরে বেশ কিছু এলাকায় কার্ফু জারি করা হয় এবং বেশ কিছু এলাকায় গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এই খুনের ঘটনায় আজ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ বা প্রশাসন। খুনি কারা, তা আজও রহস্য হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। যদিও খুন হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে।
পরের ঘটনা সিপিআইএম (লিবারেশন) নেতা চন্দ্রশেখর প্রসাদ হত্যাকাণ্ড। বিহারের সিবানে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাঁর। সেনা অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়েও সেখানে থেকে চলে আসেন রাজনীতিবিদ হবেন বলে।
জেএনইউ-তে ভর্তি হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে লিবারেশনের সংগঠন গড়ে তোলার পিছনে বড় হাত ছিল চন্দ্রশেখরের। তিন বছর পর পর ছাত্রভোটে জয় লাভ করেছিলেন। তার মধ্যে দু’বার সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালের ৩১ মার্চ সিবানে এক সভায় বক্তৃতা চলাকালীন গুলি করে হত্যা করা হয় চন্দ্রশেখরকে। অভিযোগের তির ছিল আরজেডি নেতা মহম্মদ শাহাবুদ্দিনের দিকে। কিন্তু তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর কারণ হিসেবে জনসাধারণের মধ্যে তাঁর প্রবল জনপ্রিয়তাকে দায়ী করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে দেশের ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হলেও মূল আসামি আজও অধরা।
রাজীব দীক্ষিত ছিলেন সমাজসেবী। বিশ্বায়ন, বেসরকারিকরণের ক্ষতিকর দিক নিয়ে তাঁকে প্রায়শই বক্তৃতা দিতে দেখা যেত। রাজীব-হত্যা আজও রহস্য।
তাঁর নেতৃত্বে বেশ কিছু বড় আন্দোলন হয়েছিল। করের বিকেন্দ্রীকরণের জন্যও তিনি লড়াই করেছিলেন। তাঁর মতে, জনসাধারণের করের ৮০ শতাংশ যায় নেতা-মন্ত্রী এবং আমলাদের ভরণপোষণে এবং বাকি ২০ শতাংশ উন্নয়নের কাজ ব্যবহৃত হয়। ৯/১১-র মতো বিষয় নিয়েও তাঁর মত ছিল ‘বিতর্কিত’। ক্রমাগত সরকারের বিরুদ্ধ মতপোষণ এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় তাঁর অনেক শত্রু তৈরি হয়েছিল। ২০১১ সালের ৩০ মে, ছত্তিসগড়ের ভিলাইয়ে এক বক্তৃতা চলাকালীনই তিনি হৃদ্রোগ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সবচেয়ে রহস্য, তাঁর দেহের ময়নাতদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। মারা যাওয়ার পর তাঁর সারা শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল। যা কি না বিষক্রিয়ার লক্ষণ। রাজীবের মৃত্যুর কারণ কী, হৃদ্রোগ না বিষক্রিয়া, তা আজও জানা যায়নি।
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু ভারতের ইতিহাসে অন্যতম রহস্যজনক অধ্যায়। ১৯৬৬ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানের তাসখণ্ডে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। লাল বাহাদুরই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি বিদেশের মাটিতে মারা গিয়েছেন।
তাঁর মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি। গবেষকদের একাংশ মনে করেন, তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিল। তথ্যের অধিকার আইনে অনেকগুলি মামলা করা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ জানাতে চেয়ে। কিন্তু সরকার সবক’টি আবেদনই বাতিল করে দেয়।
গ্রেগরি ক্রাউলি নামে এক সাংবাদিক তাঁর বইয়ে দাবি করেন, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী সিআইএ। শুধু শাস্ত্রীই নন, পরমাণু বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গির ভাবার মৃত্যুর জন্যও দায়ী সিআইএ। এই দাবির সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা যায়নি এখনও।
আমেরিকা ওই সময় ভারতের পরমাণু নীতি নিয়ে চিন্তিত ছিল এবং শাস্ত্রী আরও পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আসল কারণ আজও কাছে অজানা।
উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলি ছাড়াও রিজওয়ানুর রহমান মৃত্যু, আরুষি তলোয়ার-হেমরাজের মৃত্যু, সুনন্দা পুষ্করের মৃত্যু আজও রহস্য হিসেবেই রয়ে গিয়েছে।
মৃত্যু না হত্যা—তা নিয়ে তদন্ত হলেও প্রকৃত সত্য এখনও উঠে আসেনি।