ভারতীয় ক্রিকেটার ঋষভ পন্থও ধরতে পারেননি তাঁর ছদ্মবেশ। আইপিএল ক্রিকেটার সেজে তাঁকে বোকা বানিয়েছেন। লুটে নিয়েছেন কোটি টাকা। নাম মৃণাঙ্ক সিংহ। বয়স ২৫। এই তরুণ প্রতারকের কাণ্ড যত প্রকাশ্যে আসছে ততই বিস্ময়ের বাঁধ ভাঙছে দিল্লি পুলিশের।
এক সময় হরিয়ানা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে অনূর্ধ্ব-উনিশ দলে ক্রিকেট খেলতেন। ক্রিকেটের সঙ্গে মৃণাঙ্কের যোগ ওই পর্যন্তই। তবে নকল যোগের জল গড়িয়েছে বহু দূর।
নিজেকে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস এবং মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ক্রিকেটার বলে পরিচয় দেওয়া মৃণাঙ্ক বোকা বানিয়েছেন ক্রিকেটারদের সাজ-সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী ব্র্যান্ডকেও। রিবক, অ্যাডিডাসের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা এই নকল ক্রিকেটারের ফাঁদে পড়েছে।
বরাবরই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মৃণাঙ্ক। বিলাসবহুল হোটেলে থাকা, দামি রেস্তরাঁয় খাওয়াদাওয়া, দামি ব্র্যান্ডের পোশাক পরা, নিত্যদিনের নারীসঙ্গকে অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সেই অভ্যাস বজায় রাখার উপায়ও বানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের মতো করে।
পরিকল্পনা সফল করার জন্য নিজের দু’টি পরিচয় বানিয়েছিলেন মৃণাঙ্ক। এক, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স আইপিএল দলের সদস্য। মৃণাঙ্ক দাবি করতেন, তিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মুম্বইয়ের হয়ে আইপিএল খেলেছেন। ক্রিকেটার হিসাবে জনপ্রিয়ও ছিলেন।
বস্তুত এই কাহিনি শুনিয়েই মহিলাদের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতেন মৃণাঙ্ক। তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাপন দেখে অবিশ্বাস করার কথা ভাবতেনই না কেউ।
মৃণাঙ্কও তাঁর এই নকল পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে মহিলাদের নিয়ে দামি হোটেল, রেস্তরাঁয় সময় কাটাতেন। ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করতেন তাঁর দামি জীবনযাপনের ছবি।
সেই কৌশল যে কাজে লেগেছিল, তার প্রমাণ মৃণাঙ্কের ইনস্টাগ্রাম অনুরাগীর সংখ্যা। সেখানে ৪০ হাজার নেটাগরিক ফলো করেন মৃণাঙ্ককে।
সম্ভবত মৃণাঙ্কের ইনস্টাগ্রামের ছবি আর অনুগামীর সংখ্যাতেই ধোঁকা খেয়েছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সরঞ্জাম তৈরির ব্র্যান্ডগুলিও। মৃণাঙ্ককে দিয়ে কখনও ব্যাট, কখনও ঘড়ি, কখনও বা ক্রিকেটারের সাজপোশাকের ব্র্যান্ডিং করিয়েছে তারা। মৃণাঙ্ক নিজের প্রোফাইলে পোস্টও করেছেন সেই সব ছবি।
তবে সব কাহিনিতেই মোচড় থাকে। মৃণাঙ্কের গল্পও ব্যতিক্রম নয়। তাঁর নকল কাহিনিই শেষ পর্যন্ত ধরিয়ে দিল তাঁকে।
২০২১ সালে প্রথম বার মৃণাঙ্কের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়। ভারতীয় ক্রিকেট দলের উইকেটকিপার ঋষভ পন্থ করেছিলেন সেই অভিযোগ। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ভারতের উইকেটকিপারের সামনে মৃণাঙ্ক বলেছিলেন, তিনি দামি ঘড়ি এবং গয়না বেচাকেনা করেন। তাঁকে বিশ্বাস করে পন্থ নিজের একটি দামি ঘড়ি বিক্রি করে দেন।
পন্থকে ওই ঘড়ির বদলে ১.৬ কোটি টাকার চেক দিয়েছিলেন মৃণাঙ্ক। যা ‘বাউন্স’ করে। মৃণাঙ্কও যেন হাওয়ায় উবে যান। সে সময় পন্থ পুলিশে অভিযোগ জানালেও অপরাধের কিনারা করা যায়নি।
এর পরে মৃণাঙ্কের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে দ্বিতীয় অভিযোগ দায়ের হয় ২০২২ সালে। অভিযোগ জানায় দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেল। মৃণাঙ্কের বিরুদ্ধে ৫ লক্ষ ৫৩ হাজার টাকার প্রতারণার অভিযোগ করে তারা।
পুলিশকে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানান, সাত দিনের জন্য দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলে ছিলেন মৃণাঙ্ক। বিল হয়েছিল ৫ লক্ষ ৫৩ হাজার টাকা। কিন্তু হোটেল ছাড়ার সময় সেই বিল ধরানো হলে মৃণাঙ্ক জানান, এই বিল তাঁর নয়, অ্যাডিডাসের দেওয়ার কথা।
হোটেলকর্মীরা তাঁকে ব্যাঙ্কের তথ্য জানাতে বলেন। মৃণাঙ্কও দু’লক্ষ টাকার একটি টাকা লেনদেনের আইডি শেয়ার করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ওটি একটি ভুয়ো লেনদেনের আইডি। তত দিনে হোটেলকর্মীদের বোকা বানিয়ে উধাও হয়েছেন মৃণাঙ্ক।
হোটেলের তরফে বহু বার যোগাযোগ করা হয় মৃণাঙ্ককে। তিনি প্রথমে পাওনা মেটানোর ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেন। তার কিছু দিন পরে বন্ধ করে দেন ফোন। বাধ্য হয়ে পুলিশে খবর দেন হোটেল কর্তৃপক্ষ। পুলিশ খুঁজতে শুরু করে মৃণাঙ্ককে।
মৃণাঙ্ক অবশ্য তার পরও থামেননি। পরিচিতদের বলতে শুরু করেন, তিনি দুবাইয়ে থাকেন। অন্য দিকে পুলিশের তদন্তে দেখা যায়, দিল্লির ওই হোটেলের মতো বহু বিলাসবহুল হোটেলেই রাত কাটিয়ে বিল মেটাননি মৃণাঙ্ক। তবে এই সব হোটেলে তিনি ক্রিকেটার হিসাবে থাকেননি। থেকেছেন কর্নাটকের এক আইপিএস অফিসার হিসাবে।
মৃণাঙ্কের ঠিকানায় এর পর একের পর এক নোটিস পাঠিয়েছে পুলিশ। জবাব না পেয়ে তাঁর বাড়িতে গেলে জানিয়ে দেওয়া হয়, মৃণাঙ্কের সঙ্গে তাঁর পরিবারের দীর্ঘ দিন কোনও যোগাযোগ নেই। মৃণাঙ্কের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তাঁরা।
মৃণাঙ্ককের পরিচিতদের কাছে তাঁর দুবাই যাওয়ার কথা জানতে পারে পুলিশ। এর পরেই তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা হয় লুক আউট নোটিস। জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানাও তৈরি করা হয় মৃণাঙ্কের নামে। সোমবার দিল্লি বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয় মৃণাঙ্ককে।
হংকংয়ে যাওয়ার বিমান ধরতে এসেছিলেন মৃণাঙ্ক। অভিবাসন দফতরের আধিকারিকেরা আটকে দেন তাঁকে। মৃণাঙ্ক অবশ্য তার পরেও নিজের পরিচয় বদলানোর চেষ্টা করেছিলেন।
কর্নাটক পুলিশের অতিরিক্ত ডিজি অলোক কুমার হিসাবে পরিচয় দিয়ে দিল্লি পুলিশের পদস্থ কর্তাদের ফোন করেন মৃণাঙ্ক। পুলিশকে বলেন, ‘‘আমার পুত্র মৃণাঙ্ক সিংহকে দিল্লি পুলিশ বেআইনি ভাবে আটকে রেখেছে দিল্লি বিমানবন্দরে। ওকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।’’ পুলিশ অবশ্য সেই ফাঁদে পা দেয়নি। মৃণাঙ্ককে গ্রেফতার করা হয়। আপাতত দিল্লি পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন তিনি।
তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে মৃণাঙ্ক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক হওয়ার পর ওপিজেএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবসম্পদ নিয়ে এমবিএ করেছিলেন তিনি।
তবে মৃণাঙ্কের মোবাইল ফোন থেকে তার কীর্তির বিশদ জানতে পেরেছে পুলিশ। দিল্লি পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মোবাইলে বহু মহিলার সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ছবি পাওয়া গিয়েছে মৃণাঙ্কের। পাওয়া গিয়েছে মাদক কেনাবেচার প্রমাণও। মৃণাঙ্কের বিরুদ্ধে তদন্তে এই সমস্ত দিকও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।