এশিয়া কাপের ফাইনালে রেকর্ড গড়লেন মহম্মদ সিরাজ। প্রথম ভারতীয় বোলার হিসাবে এক ওভারে নিলেন চার চারটি উইকেট। তাঁর বোলিংয়েই প্রথম থেকে চালকের আসনে ভারত। শেষ পর্যন্ত ৬ উইকেট নিলেন এই ভারতীয় পেসার।
এশিয়া কাপের ফাইনালে অষ্টম বার মুখোমুখি হয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কা। বৃষ্টির জেরে নির্ধারিত সময়ের খানিকটা পরে শুরু হয় খেলা। টসে হারে ভারত। আর শুরুতেই বল হাতে আগুন ঝরালেন মহম্মদ সিরাজ। এক ওভারে চার চারটি উইকেট নিলেন এই ফাস্ট বোলার।
ইনিংসের চতুর্থ ওভারে বল করতে এসে এই সাফল্য পান সিরাজ। তাঁর আগুনে বোলিংয়ে বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইন-আপ। বস্তুত, খেলার শুরুতেই শ্রীলঙ্কার আধা দলকে সাজঘরে ফিরিয়ে দেন সিরাজ এবং বুমরা জুটি।
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন তাঁর ছোট থেকেই। হায়দরাবাদের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছেন এই পেসার। বাবা মহম্মদ ঘাউস ছিলেন অটোচালক। সিরাজের স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার। ধীরে ধীরে রাজ্য, আইপিএল এবং জাতীয় দলে পাকাপাকি জায়গা করে নেন ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির এই বোলার।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সিরাজের অভিষেক ২০১৫-১৬ সালের রঞ্জি ট্রফিতে। পরের বার রঞ্জি ট্রফিতে ৯ ম্যাচে ৪১টি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। আর ২০১৭-১৮ সালে বিজয় হজারে ট্রফিতে ২৩টি উইকেট নিয়ে সে বারের সেরা উইকেট শিকারি হন এই হায়দরাবাদি।
তবে প্রথম বার সিরাজ সবার চোখ টানেন ২০১৭ সালের আইপিএলে। ২.৬ কোটি টাকা দর ওঠে তাঁর। তবে ২০১৮ সালে হায়দরাবাদের দল ছেড়ে বিরাট কোহলির রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুতে চলে আসেন তিনি। সে বারের আইপিএলে ১১টি উইকেট নেন সিরাজ।
প্রথম থেকে নিজের জাত চিনিয়ে আসছেন এই ডান হাতি ফাস্ট বোলার। ২০২০ সালে বড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন সিরাজ। টি২০ ক্রিকেটে তিনিই প্রথম ভারতীয় বোলার যিনি চার ওভার হাত ঘুরিয়ে দুটো ওভার মেডেন নিয়েছেন। অর্থাৎ, ওই দুই ওভারে একটি রানও দেননি সিরাজ।
দেশের জার্সিতে সিরাজের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ ২০১৭ সালে। নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিলেন। জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচে সিরাজের শিকার ছিলেন কেন উইলিয়ামসন। কিন্তু চার ওভারে ৫৩ রান দিয়েছিলেন।
ভাল যায়নি সিরাজের জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক এক দিনের ম্যাচও। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১০ ওভার হাত ঘুরিয়ে সিরাজ রান দিয়েছিলেন ৭৯।
২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজের ভারতীয় দলে জায়গা পেয়েছিলেন সিরাজ। কিন্তু বসে থাকতে হয় সাজঘরেই। বস্তুত, জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট খেলার জন্য সিরাজকে অপেক্ষা করতে হয় আরও দু’বছর। প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্টও খেলতে নামেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
ওই সিরিজে দেশের জন্য অনন্য ভূমিকা নিয়েছিলেন সিরাজ। তিন ম্যাচে তাঁর ঝুলিতে ছিল ১৩ উইকেট। ওই সিরিজ়ে তিনিই ছিলেন ভারতের সেরা উইকেট শিকারি।
২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামে ভারত। খেলা চলছিল সিডনিতে। হঠাৎ সিরাজকে করা আক্রমণ শুরু হয়। অস্ট্রেলীয় দর্শকদের একাংশ সিরাজকে উদ্দেশ্য করে কটাক্ষ শুরু করেন। বর্ণবিদ্বেষীমূলক মন্তব্য হয়। অভিযোগ, ‘ব্রাউন ডগ’, ‘বিগ মাঙ্কি’ বলে ডাকা হয় তাঁকে। প্রতিবাদ করেছিলেন সিরাজ। পরে দেখা যায় ওই দর্শকদের সরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ।
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিরাজের বলের মোক্ষম দুই অস্ত্র হল গতি এবং ইয়র্কার। আর সাফল্যের রহস্য, তিনি সাংঘাতিক খাটিয়ে। শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে চান। যার খানিক পরিচয় মিলল এশিয়া কাপের ফাইনালে। চতুর্থ ওভারের প্রথম চার বলে তিনটি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। হ্যাটট্রিকের পরিস্থিতি ছিল। তাই ঢেলে ফিল্ডিং সাজিয়েছিলেন ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। ব্যাট করছিলেন ধনঞ্জয় ডি’সিলভা। সিরাজ তাঁর প্যাডের দিকে বল করেন। ধনঞ্জয় মিড অনের দিকে খেলেন। আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজানোয় সেই অঞ্চলে কোনও ভারতীয় ফিল্ডার ছিল না। ফলে সিরাজ নিজেই বলের পিছনে ছোটেন। তাঁর ওই মরিয়া দৌড় দেখে হেসে ফেলেন কোহলিরা।
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে নিজের প্রথম স্পেলেই ৫ উইকেট তুলে নিয়েছেন সিরাজ। ২ ওভারে ৪ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি।
ভারতীয় দলের তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। আসলে ভারতীয় পেসার মহম্মদ সিরাজের পছন্দের ফুটবলার তিনি। এশিয়া কাপে খেলতে নামার আগে ছবি তোলা হয়। সেখানে রোনাল্ডো যে ভাবে ছবি তোলেন, সেই ভঙ্গিমায় ছবি তোলেন সিরাজ।
ফাইনালে ৭ ওভার বল করে ৬ উইকেট নেওয়ার পরও সিআর সেভেনের ভঙ্গিমায় সেলিব্রেশন করতে দেখা গেল তাঁকে। বুঝিয়ে দিলেন এশিয়া কাপে তিনিই ‘নবাব’।