ফ্রান্সের ওয়াইন ব্যবসায়ী মিশেল পন্ত। তিনি এক জন প্রাক্তন সেনাকর্মীও বটে। বিশেষ কারণে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম রয়েছে মিশেলর। কারণ? একটা-দু’টো না শতাধিক যুদ্ধবিমানের মালিক এই মিশেল। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার থেকেও বেশি যুদ্ধবিমান রয়েছে মিশেলের সংগ্রহে।
মিশেল পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যাঁর কাছে এত যুদ্ধবিমান আছে। মোট ১১০টি যুদ্ধবিমান রয়েছে তাঁর কাছে। ফ্রান্সের বারগান্ডি অঞ্চলের বাসিন্দা মিশেল বাড়ির কাছে একরের পর একর জুড়ে আঙুর চাষ করেন। এ ছাড়া তাঁর শখ বলতে যুদ্ধবিমান এবং পুরনো গাড়ি সংগ্রহ করা।
সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর মিশেল ঠিক করেন তিনি ওয়াইনের ব্যবসা করবেন। বিভিন্ন ধরনের ওয়াইন তৈরির জন্য ফ্রান্সের বারগান্ডির বিশ্বজোড়া নাম রয়েছে। তাই বারগান্ডিতেই ১২ হেক্টর (প্রায় ৩০ একর) জমি কিনে নেন মিশেল। ১৩৪০ সালে তৈরি একটি দুর্গ-সহ ওই জমি কেনেন মিশেল।
ওই এলাকার জমির দাম কম হওয়ার কারণেই মিশেল একসঙ্গে এত জমি কিনে নেন। ঠিক করেন, ১২ হেক্টরের মধ্যে চার হেক্টর জমিতে আঙুর চাষ করবেন। আর দুর্গ লাগোয়া তিন হেক্টর জমি বেছে নেন সংগ্রহে থাকা যুদ্ধবিমান রাখার জন্য।
১৯৮০ সাল থেকে সংগ্রহ শুরু করেন মিশেল। সেনার যুদ্ধবিমানের চালক হওয়ার আগে মিশেল কার রেসিং করতেন। একটি রেস জেতার জন্য সেনার তরফে পুরস্কার হিসেবে তাঁকে একটি যুদ্ধবিমান দেওয়া হয়।
এর পরই সেনায় যুদ্ধবিমান সংগ্রহের নেশা চেপে যায় মিশেলের। নিজে পাইলট হওয়ায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভালই যোগাযোগ ছিল তাঁর। তাই বাতিল হওয়া বিমানগুলি তিনি বাহিনীর কাছ থেকে কম দামে কিনতে শুরু করেন। একটা, দুটো থেকে বাড়তে বাড়তে এখন ১১০টি যুদ্ধবিমানের মালিক তিনি।
মিশেলের কাছে থাকা ১১০টি যুদ্ধবিমানের মধ্যে রয়েছে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টারও।
মিশেলের সংগ্রহে একদম প্রথম দিকের যুদ্ধবিমান রয়্যাল এয়ারফোর্সের ‘মিটিওর ফাইটার’ থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক ‘এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন’ বিমানও রয়েছে। ‘মিটিওর ফাইটার’ ব্রিটেনের প্রথম ‘ফাইটার জেট’। এটিই একমাত্র যুদ্ধবিমান যা দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়ই কার্যকর ছিল।
জার্মান বায়ুসেনা ‘লুফৎয়াফ’-এর এফ-৮৬ সাবরে যুদ্ধবিমানও রয়েছে মিশেলের সংগ্রহে। ৫০-এর দশকে জার্মানিতে এই যুদ্ধবিমান সক্রিয় ছিল।
এ ছাড়াও লকহিড ‘এফ-১০৪ স্টারফাইটার’, ‘ইংলিশ ইলেকট্রিক লাইটনিং’, ‘এফ-১০০ সুপার সাবরে’ এবং ‘মিরাজ-৩ ফাইটার’-সহ ৬০ এবং ৭০-এর দশকের বহু যুদ্ধবিমান মিশেলের সংগ্রহে রয়েছে।
মিশেলের কাছে ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুদ্ধবিমানও রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল ‘রিপাবলিক এফ-১০৫ থান্ডারচিফ’। আমেরিকার বায়ুসেনার অন্যতম বড় এই যুদ্ধবিমান ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে মিশেলের সংগ্রহে এই যুদ্ধবিমান কী ভাবে এল তার সদুত্তর ছিল না আমেরিকার কাছেও।
আমেরিকার যুদ্ধবিমান ছাড়াও মিশেলের কাছে রাশিয়ার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিমানও রয়েছে। এর মধ্যে সুখোই ‘ফিটার’ এবং মিগ-২১ ‘ফিশবেড’ যুদ্ধবিমানও রয়েছে। পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরি থেকে এই যুদ্ধবিমানগুলি সংগ্রহ করেন মিশেল। আফ্রিকার জিবুতি থেকেও একটি বিমান কিনে সংগ্রহে রেখেছেন তিনি।
মিশেলের সংগ্রহে সবচেয়ে আধুনিক যে যুদ্ধবিমানটি রয়েছে, তা হল ‘এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন’। মিশেল জানিয়েছিলেন, বেলজিয়ামের বায়ুসেনার এক প্রধানের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। ওই সেনাকর্তার কাছে এফ-১৬ বিমানটি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন মিশেল।
এফ-১৬ যুদ্ধবিমান আমেরিকার হওয়ায় কেনার অনুমতি পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল মিশেলকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মিশেল এই যুদ্ধবিমান কেনার অনুমতি পান এবং বিমানটি বেলজিয়াম বায়ুসেনার কাছ থেকে কিনে নেন।
পৃথিবীর আর কোনও মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহে একসঙ্গে এতগুলো যুদ্ধবিমান নেই। এই কৃতিত্বের জেরেই গিনেস বুকে জায়গা করে নিয়েছেন মিশেল।
২০১৯-এ গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্সের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের কাছে ৯০টি এবং শ্রীলঙ্কার রয়েছে ৭৬টি যুদ্ধবিমান রয়েছে। সেখানে মাইকেলের একার সংগ্রহেই রয়েছে ১১০টি যুদ্ধবিমান।
তবে মিশেলের কাছে যে যুদ্ধবিমানগুলি রয়েছে, সেগুলো এখন আর সচল নেই। শুধু মাত্র প্রদর্শনীর জন্য এই যুদ্ধবিমানগুলোকে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। দুর্গ লাগোয়া যুদ্ধবিমানের এই সংগ্রহশালা মিশেল সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দিয়েছেন।
প্রতি দিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দুপুর ২টো থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এই সংগ্রহশালা খোলা থাকে। পাশাপাশি ঘুরে দেখা যায় দুর্গও। প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার পর্যটক আসেন মাইকেলের এই সংগ্রহশালা দেখার জন্য।
মিশেল জানিয়েছেন, বর্তমানে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। আর তাই তাঁর সংগ্রহশালায় নতুন সংগ্রহ প্রায় নেয় বললেই চলে।
আন্তর্জাতিক কালোবাজারে চড়া দামে সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পাওয়া গেলেও সেই পথে হাঁটতে নারাজ মিশেল। স্পষ্ট জানিয়েছেন তিনি।
শুধু যুদ্ধবিমানই নয়, মিশেলের সংগ্রহে রয়েছে ২০০টি বহুমূল্যবান পুরনো বাইক ও ৩৬টি রেসিং কার। এগুলির জন্যও মিশেলকে তাঁর দুর্গে ৯টি সংগ্রহশালা খুলতে হয়েছে।