Indus Water Treaty Row

ভারতকে যুদ্ধের হুঙ্কারই সার, সিন্ধুর জলের আশা শেষ হতেই খাল কাটায় দাঁড়ি টেনে ‘কৃষি কবরে’ পাকিস্তান

পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার জেরে সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। নদীর জল পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে এ বার চোলিস্তান সেচখালের কাজ বন্ধ করল পাকিস্তান।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:৫৮
Share:
০১ ২০
Pakistan halts Cholistan canal irrigation project amid Indus water treaty pause by India

পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পাকিস্তান। এই আবহে ত়ড়িঘড়ি চোলিস্তান সেচখাল প্রকল্প স্থগিত করল ইসলামাবাদ। ইতিমধ্যেই সিন্ধু জল চুক্তিতে রাশ টেনেছে ভারত। এর জেরে একরকম বাধ্য হয়ে শাহবাজ় শরিফ সরকারকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হল, বলছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। যদিও সরকারি ভাবে তা মানতে নারাজ পশ্চিমের প্রতিবেশী।

০২ ২০
Pakistan halts Cholistan canal irrigation project amid Indus water treaty pause by India

চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল চোলিস্তান সেচখাল প্রকল্প বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করে শরিফ সরকার। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এর নির্মাণকাজ চলছিল। ওই দিন উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এবং পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নওয়াজ়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফের কন্যা মরিয়ম আবার সম্পর্কে শাহবাজ়ের ভাইঝি হন।

Advertisement
০৩ ২০
Pakistan halts Cholistan canal irrigation project amid Indus water treaty pause by India

চোলিস্তান সেচখাল প্রকল্প স্থগিতের বিবৃতিতে শাহবাজ় সরকার বলেছে, যত দিন পর্যন্ত ‘সাধারণ স্বার্থ পরিষদ’-এর (পড়ুন কাউন্সিল অফ কমন ইন্টারেস্টস বা সিসিআই) সদস্যেরা এ ব্যাপারে একমত হবেন না, তত দিন কাজ বন্ধ থাকবে। বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি চিরতরে ঠান্ডা ঘরে যেতে চলেছে বলে আগাম পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছেন।

০৪ ২০

কৃষিভিত্তিক পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল বেশ শুষ্ক। আর তাই সেখানকার চাষের জমিতে জল পৌঁছে দিতে চোলিস্তান সেচখাল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে শরিফ সরকার। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি তোলে একাধিক শরিক দল। এদের মধ্যে অন্যতম হল সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টোর তৈরি পাকিস্তান পিপল্স পার্টি বা পিপিপি।

০৫ ২০

শরিফ সরকারের অন্যতম বড় শরিক হল পিপিপি। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ এই রাজনৈতিক দলটির গড় হিসাবে পরিচিত। পিপিপির অভিযোগ, চোলিস্তান সেচখাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চাষের জলের একচেটিয়া অধিকার পাবেন পঞ্জাবের কৃষকেরা। অন্য দিকে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে সিন্ধু নদীর নিম্ন অববাহিকার সিন্ধু প্রদেশ। আর তাই প্রকল্পের কাজ শুরু হতে না হতেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছিল পিপিপি।

০৬ ২০

এই পরিস্থিতিতে সমস্যা মেটাতে শরিক দলটির চেয়ারম্যান বিলাবল ভুট্টো জ়ারদারির সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ়ের (পিএমএল-এন) নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। পরে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে বিলাবল বলেন, ‘‘পারস্পরিক সম্মতিতে চোলিস্তান সেচখালের কাজ আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ করবে সরকার।’’

০৭ ২০

২০২৩ সালে ‘পাকিস্তানের সবুজায়ন উদ্যোগ’ (গ্রিন পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভ) নামের একটি প্রকল্পের সূচনা করে ইসলামাবাদ। এর মূল উদ্দেশ্য হল কৃষির উন্নতিসাধন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির আওতায় চোলিস্তান সেচখাল কাটার কথা ছিল। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধু ও বালোচিস্তান— এই তিনটি প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষের জল পৌঁছোনোর কথা ছিল।

০৮ ২০

উল্লেখ্য, চোলিস্তান প্রকল্পে কয়েক লক্ষ একর মরু এলাকায় মোট ছ’টি খাল কাটার কথা বলা রয়েছে। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধু ও বালোচিস্তান— তিন প্রদেশের জন্য দু’টি করে খাল বরাদ্দ করেছিল পাক সরকার। শুধু তা-ই নয়, পাঁচটি খাল সিন্ধু নদী এবং একটি খাল সিন্ধুরই শাখানদী শতদ্রু থেকে কাটার পরিকল্পনা করে ইসলামাবাদ।

০৯ ২০

গত মার্চে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে সিন্ধু প্রদেশে সর্বাধিক বিক্ষোভ দানা বাঁধে। সেখানকার আইনসভায় এর বিরোধিতা করে পাশ হয় একটি প্রস্তাব। পাশাপাশি, এই ইস্যুতে শরিফ সরকারকে ‘ফল ভুগতে হবে’ বলে রীতিমতো হুঙ্কার দেয় অন্যতম শরিক দল পিপিপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে কুর্সি বাঁচাতে প্রকল্প স্থগিতের ফিকির খুঁজছিলেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়।

১০ ২০

বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, পহেলগাঁও হামলার পর ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করায় হাতে চাঁদ পেয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি নদীর জল আটকে দিলে খাল কেটে যে কোনও লাভ নেই, তা সবাইকে বোঝাতে পারবেন শাহবাজ়। দ্বিতীয়ত, চোলিস্তান খাল প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে শরিকি বিবাদ মোটের উপর মিটিয়ে ফেলতে পারবেন তিনি।

১১ ২০

তবে ভারত সিন্ধু জল চুক্তি পুরোপুরি ভেঙে দিলে পাকিস্তান যে তীব্র জলসঙ্কটে পড়বে তা ভাল রকম জানেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। আর তাই এ ব্যাপারে বার বার নয়াদিল্লিকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। পাক সরকারের বক্তব্য, সিন্ধুর প্রতিটা জলকণায় তাদের অধিকার রয়েছে। তাই জল আটকালে তাকে যুদ্ধ হিসাবেই দেখা হবে বলে স্পষ্ট করে দিয়েছে ইসলামাবাদ।

১২ ২০

গত ২৩ এপ্রিল সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের কথা ঘোষণা করে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। ঠিক তার পরের দিনই শিমলা চুক্তি-সহ একাধিক সমঝোতা স্থগিত এবং বাণিজ্য বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দেয় ইসলামাবাদ। কিন্তু, তাতেও সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে পাক জলসম্পদমন্ত্রী সৈয়দ আলি মুর্তজাকে চি‌ঠি পাঠিয়েছেন এ দেশের জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখোপাধ্যায়। সেখানেই আনুষ্ঠানিক ভাবে সিন্ধু চুক্তি বাতিলের বিষয়টি পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

১৩ ২০

ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে বলা হয়েছে, সিন্ধু চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যত দিন পর্যন্ত সীমান্তপার সন্ত্রাস চলবে, তত দিন এই চুক্তি স্থগিত থাকবে বলে স্পষ্ট করেছে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে যে কোনও মুহূর্তে চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারে মোদী সরকার।

১৪ ২০

গত বছরই এই চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন করতে চেয়ে ইসলামাবাদকে দু’বার চিঠি দেয় নয়াদিল্লি। কিন্তু, কেন্দ্রের প্রস্তাবে রাজি হয়নি পাকিস্তান। ইসলামাবাদের যুক্তি ছিল, অন্যায্য ভাবে নিজেদের স্বার্থে চুক্তিটিকে ব্যবহার করছে ভারত। তখন থেকেই এ ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে উত্তাপ চড়ছিল।

১৫ ২০

১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খানের মধ্যে সিন্ধু নদীর জল বণ্টন নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের করাচি শহরে গিয়ে এই চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু। দীর্ঘ ন’বছর আলোচনা চলার পর চুক্তিটি বাস্তবের মুখ দেখেছিল। এর মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বিশ্ব ব্যাঙ্ক একটি সালিশি আদালত তৈরি করে। এর প্রবল বিরোধিতা করে এসেছে নয়াদিল্লি।

১৬ ২০

সিন্ধু জলচুক্তির প্রস্তাবনায় বলা রয়েছে, ‘‘ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদীগুলির জল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা ও বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। সহযোগিতামূলক মনোভাবের উপর ভিত্তি করে এই চুক্তি তৈরি করা হয়েছে।’’

১৭ ২০

সিন্ধু নদীর উৎপত্তি দক্ষিণ-পশ্চিম তিব্বতের মানস সরোবর সংলগ্ন একটি প্রস্রবণ থেকে। এর মূল উপনদী হল বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী ও বিপাশা। সিন্ধু জল চুক্তিতে এই নদীগুলির জলের ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও চুক্তিতে শতদ্রু নদীর জলের ব্যবহারের কথাও বলা রয়েছে।

১৮ ২০

চুক্তি অনুযায়ী, পূর্ব দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। অন্য দিকে পশ্চিম দিকের সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল ব্যবহার করতে পারবে পাকিস্তান। জলের নিরিখে সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদী মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ভারত ও ৭০ শতাংশ পাবে পাকিস্তান।

১৯ ২০

পশ্চিম দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল নয়াদিল্লি যে একেবারেই ব্যবহার করতে পারবে না, এমনটা নয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে এই তিনটি নদীর জল স্থানীয় ভাবে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ভারত। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ চলাচল ও মাছচাষের জন্য ভারতের এই তিনটি নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।

২০ ২০

সিন্ধু জলচুক্তি হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে তিন বার যুদ্ধে জড়ায় পাকিস্তান। প্রতি বারই হার মানতে হয়েছে ইসলামাবাদকে। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে কাশ্মীরে সীমান্ত পার সন্ত্রাসে মদত দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স)। কিন্তু এত দিন তা সত্ত্বেও এই চুক্তি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি নয়াদিল্লি। মোদী সরকারের এ বারের পদক্ষেপে নদীর জলের জন্য দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement