কর্নাটকের প্রথম রূপান্তরকামী মহিলা চিকিৎসক। চিকিৎসাক্ষেত্র থেকে সরাসরি অভিনয়জগতে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা গেল ত্রিনেত্রা হালদার গুম্মারাজুকে।
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মেড ইন হেভেন’ ওয়েব সিরিজ়ের দ্বিতীয় পর্বে মেহের চরিত্রে অভিনয় করে সেই নামেই অধিকাংশ জায়গায় পরিচিতি পাচ্ছেন ত্রিনেত্রা।
‘মেড ইন হেভেন’ ওয়েব সিরিজ়ে রূপান্তরকামী মহিলার চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে ত্রিনেত্রাকে। অভিনয়ের মাধ্যমেই দর্শকমনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
মেহের চরিত্রটি ত্রিনেত্রা এমন ভাবে আত্মস্থ করেছিলেন, যেন নিজের জীবনের কথাই ফুটিয়ে তুলেছেন পর্দায়। আসলে ত্রিনেত্রা নিজেও রূপান্তরকামী নারী। সেই চরিত্রেই অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
১৯৯৭ সালের ১৭ জুন কর্নাটকে জন্ম ত্রিনেত্রার। বাবা, মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে সেখানেই থাকতেন তিনি। জন্মের সময় তাঁর নাম ছিল অঙ্গদ গুম্মারাজু।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভাল ছিলেন অঙ্গদ। পড়াশোনার পাশাপাশি আঁকার প্রতিও আগ্রহ ছিল তাঁর। ভাল রেজ়াল্ট নিয়ে প্রতিটি পরীক্ষায় পাশ করতেন তিনি। কানাঘুষো শোনা যায়, জন্মের পর প্রথম আট বছর পরিবার-সহ হায়দরাবাদে ছিলেন অঙ্গদ।
স্কুলজীবনেই নানারকম তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয় অঙ্গদকে। পুরুষ হয়ে জন্মালেও তাঁর মন নারীসত্তায় মোড়ানো। বাড়িতে থাকলে লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের শাড়ি, টিপ পরে সাজগোজ করতেন অঙ্গদ।
পুরুষ হয়েও অঙ্গদের মধ্যে মেয়েলি হাবভাব লক্ষ করায় তাঁর প্রতিবেশীরা নানা রকম পরামর্শ দিতে শুরু করেন। অঙ্গদের বাবা-মাকে নির্দেশ দেন, ছেলেদের সঙ্গে অঙ্গদের মেলামেশা বাড়াতে, ছেলেরা যে ধরনের কাজ করে, তাই যেন অঙ্গদকে করতে দেওয়া হয়।
এমনকি পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার পরামর্শ দিতেও বাকি রাখেননি প্রতিবেশীরা। তাঁদের ধারণা ছিল, এ সব করলে অঙ্গদ পরিপূর্ণ পুরুষ হয়ে উঠবে।
অবশেষে অঙ্গদের বাবা-মা তাঁকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান। আত্মপরিচয়, লিঙ্গপরিচয় নিয়ে ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন অঙ্গদ।
স্কুলে পড়াকালীন একটি ঘটনাও অঙ্গদের জীবনে প্রভাব ফেলে। অঙ্গদের এক সহপাঠিনীর মাথার ক্লিপ পছন্দ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু অঙ্গদ তাঁর মায়ের নাম করে সহপাঠিনীর কাছ থেকে সেই ক্লিপটা নেন। এই ঘটনাটি এক শিক্ষিকার নজরে আসে। অঙ্গদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে অঙ্গদের চুলে সেই ক্লিপটি লাগিয়ে দেন শিক্ষিকা। ক্লাসে উপস্থিত সকলে হাসাহাসি শুরু করলে অঙ্গদের মানসিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়।
দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর একটি স্কুলে পড়তেন অঙ্গদ। ভাল রেজ়াল্ট নিয়ে পাশ করে ২০১৫ সালে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়বেন বলে কলেজে ভর্তি হন তিনি।
১৮ বছর বয়সে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন অঙ্গদ। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিজের নামও পরিবর্তন করেন তিনি।
সমাজমাধ্যমে নিজের ছবি পোস্ট করে অঙ্গদ লেখেন, ‘‘আজ থেকে আমি ত্রিনেত্রা।’’ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর চিকিৎসাজনিত সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ হয়।
এক সাক্ষাৎকারে ত্রিনেত্রা জানান, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘মেড ইন হেভেন’ ওয়েব সিরিজ়ের জন্য অডিশন দেওয়ার ডাক পান তিনি। সেই সময় কলেজে ইন্টার্নশিপ করছিলেন ত্রিনেত্রা।
ত্রিনেত্রা বলেন, ‘‘আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। অডিশন দেওয়ার জন্যই প্রথম মুম্বই গিয়েছিলাম আমি। ওখানে গিয়ে আমার হারানোর কিছু ছিল না। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না আমার।’’
‘মেড ইন হেভেন’ ওয়েব সিরিজ় নির্মাতা জ়োয়া আখতারের সঙ্গে কথা বলে ত্রিনেত্রার সব ভয় কেটে গিয়েছিল বলে সাক্ষাৎকারে জানান তিনি। ত্রিনেত্রা বলেন, ‘‘জ়োয়া আমাকে বলেছিলেন আমার যদি কোথাও কোনও অসুবিধা মনে হয় তা যেন বলি। আমি খুব ভাল ভাবে কাজ করতে পেরেছি।’’
অস্ত্রোপচারের সময় ত্রিনেত্রার যাত্রা কেমন ছিল সে বিষয়ে ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউবে ভিডিয়ো পোস্ট করে অথবা নিজের ওয়েবসাইটে ব্লগ লিখে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন ত্রিনেত্রা।
২০২১ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে পাশ করেন ত্রিনেত্রা। তিনি সাক্ষাৎকারে জানান, নাকে ফুটো করানোর কারণে তাঁকে কলেজের ক্লাসরুমে এক বার ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
ত্রিনেত্রা বলেন, ‘‘আমি মেহেরের মাধ্যমে জানাতে চেয়েছি যে রূপান্তরকামী মহিলারা কোনও ক্ষেত্রে আলাদা নন। আমরাও ভালবাসা, সম্মান এবং মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। ৯৯ শতাংশ রূপান্তরকামীদের তো তাঁদের পরিবারই মেনে নিতে পারে না।’’
ত্রিনেত্রা চিকিৎসক হওয়ার পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে প্রভাবী হিসাবে কাজ করেন। ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুরাগীমহল নজরকাড়ার মতো। ইতিমধ্যে ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা আড়াই লক্ষের গণ্ডি পার করে ফেলেছে।