কেরলের সোনা পাচার-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত স্বপ্না সুরেশকে মঙ্গলবার তাঁর জেলা এর্নাকুলামের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে এর্নাকুলাম জেলা ও দায়রা আদালত।
৩০ কেজি সোনা আরব থেকে ভারতে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে স্বপ্নার বিরুদ্ধে। সেই সোনার দাম তখন ছিল ১৫ কোটি টাকা। পাচারে অভিযুক্ত স্বপ্না অবশ্য এখন জামিনে মুক্ত। বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে এ মাসের শুরুতে জামিন দেওয়া হয়। শর্ত ছিল, জামিনে জেল থেকে বের হলেও জেলার বাইরে বের হতে পারবেন না স্বপ্না।
সেই শর্ত কিছুটা শিথিল করেছে এর্নাকুলাম জেলা ও দায়রা আদালত। স্বপ্নাকে কেরলের রাজধানী তিরুঅনন্তপুরমে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে তারা। আর সেই সিদ্ধান্তের পরই শুরু হয়েছে জল্পনা। অনেকেই বলছেন, কাজটা করে ঝুঁকি নিয়েছে প্রশাসন।
আসলে স্বপ্না না কি চাইলেই ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারেন। পুরনো রেকর্ড বলছে, দেশে যখন পূর্ণ লকডাউন চলছে, বিমান, ট্রেন পরিষেবা বন্ধ, চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ যান চলাচলে, সর্বত্র পুলিশ গাড়ি তল্লাশি করছে, তখন বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্না। সোনা পাচারের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে কেরল থেকে স্বপ্না পৌঁছে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে। যদিও সেটা কী ভাবে সম্ভব হয়েছিল তা আজও রহস্যে মোড়া।
শুধু তাই নয়, যে ৩০ কেজি সোনা পাচারের অভিযোগ রয়েছে স্বপ্নার বিরুদ্ধে, সেই সোনাও আরব থেকে তিনি আনিয়েছিলেন করোনা পরিস্থিতিতে মালবাহী বিমানে। নিজের কূটনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে।
সেই স্বপ্না ১৫ মাস পর জেল থেকে বেরিয়ে, তিরুঅনন্তপুরমে আসার সুযোগ পাচ্ছেন।
স্বপ্না অবশ্য কথা দিয়েছেন, তিনি কোথাও উধাও হয়ে যাবেন না। তাঁর বা়ড়ি তিরুঅনন্তপুরমে। তিনি সেখানেই যেতে চান। এমনকি মা-কে সঙ্গে নিয়ে তিরুঅনন্তপুরমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন স্বপ্না।
গত বছর ১১ জুলাই বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেফতার হন স্বপ্না। নভেম্বরের গোড়ায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁকে নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণ স্বপ্নার বরাবর রহস্যে মোড়া ভাবমূর্তি।
১৯৮৪ সালে জন্ম স্বপ্নার। জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন আরবে। ২০১৩ সালে হঠাৎই আবু ধাবি থেকে চলে এসেছিলেন কেরলে। তারপর থেকে স্বপ্নার কেরিয়ার গ্রাফ সটান উপরে উঠেছে। চোরা সিঁড়িপথে ঢুকে পড়েছেন উচ্চমহলের অলিন্দে। প্রতি ধাপেই তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছে কর্মক্ষেত্রের কোনও না কোনও উচ্চপদস্থের সঙ্গে। নিয়মিত বিতর্কে থেকেছেন স্বপ্না। প্রভাবশালী বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও উঠেছে বারবার।
দেখতে সাধারণ। স্বপ্নার শিক্ষার শংসাপত্র বলছে, পড়শোনা স্নাতকস্তর পর্যন্ত। তবে স্বপ্নার আসল ক্ষমতা সম্ভবত তাঁর সপ্রতিভত ব্যবহারে। আর অনর্গল আরবি, ইংরেজি-সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারার ক্ষমতা। তার জেরেই ২০১৩ সালে এয়ার ইন্ডিয়ান স্যাটস-এর মানবসম্পদ আধিকারিকের চাকরিটা পেয়ে যান স্বপ্না।
সেখানে বিতর্কেও জড়ান। অভিযোগ, সংস্থার এক উচ্চ পদস্থ বন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক পুরুষ কর্মীকে যৌন হেনস্থার মামলায় ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করেছিলেন তিনি। সে জন্য মহিলা কর্মীদের সইও নকল করেছিলেন স্বপ্না। এই ঘটনায় স্বপ্নার বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রভাব খাটিয়েই গ্রেফতারি এড়ান বলে অভিযোগ।।
আরবি ভাষায় দখল থাকার জন্যই ২০১৬ সালে কেরলে আরব-আমিরশাহির দূতাবাসে চাকরি পান স্বপ্না। কেরল তখন আরবে কর্মরত কেরলের বাসিন্দাদের নানা সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এক সময়ে আরবের বাসিন্দা এবং আরবি ভাষার দক্ষ স্বপ্না সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করেন। উপর মহলে কদর বাড়ে তাঁর। বাড়ে প্রভাব প্রতিপত্তি। এক সময়ে নিজেকে কূটনৈতিক বলে মিথ্যে পরিচয় দিতেও শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু ফৌজদারি মামলায় তাঁর নাম থাকায় দূতাবাসের চাকরিটি হারান স্বপ্না।
কিছু দিনের মধ্যে নতুন চাকরি জুটিয়েও ফেলেন। এ বার যোগ দেন কেরলের রাজ্য সরকার পরিচালিত তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে। ঘনিষ্ঠতা বা়ড়ে কেরলের তথ্য ও প্রযুক্তি সচিব এবং আইএএস কর্তা এম শিবশঙ্করের সঙ্গে। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, শিবশঙ্করের সঙ্গে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিলেন স্বপ্না। সরকার নিয়ন্ত্রিত তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার চাকরির জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন শিবশঙ্করই।
শিবশঙ্কর ছিলেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের ঘনিষ্ঠ। তাই ২০২০ সালে যখন স্বপ্নার নাম সোনা পাচার-কাণ্ডে প্রকাশ্যে আসে, তখন সরকারের ভাবমূর্তি বাঁচাতে রাতারাতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল শিবশঙ্করকে।
দুই সন্তানের মা স্বপ্না গ্রেফতার হওয়ার আগে থাকতেন স্বামীর সঙ্গেই। যদিও পুলিশের কাছে তিনি তাঁর এক সহকর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা স্বীকার করেছেন। সরিথ নামে সেই সহকর্মী সোনা পাচার-কাণ্ডের আর এক অভিযুক্ত।
ধোঁয়াশা রয়েছে স্বপ্নার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও। এয়ার ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে দূতাবাসের চাকরি এমনকি সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থার উচ্চপদস্থ চাকুরে না কি দ্বাদশের গণ্ডীও পেরোননি। এক সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বপ্নার ভাই, জানিয়েছিলেন, তাঁর দিদি স্নাতক তো দূর, দ্বাদশের শিক্ষাও সম্পূর্ণ করেননি। যদিও স্বপ্না নিজেকে স্নাতকোত্তীর্ন বলে দাবি করেছেন।