অমর সিংহ চমকিলা। এমন এক জন শিল্পী, যিনি সে অর্থে গান শেখেননি। কিন্তু গানে পঞ্জাব জয় করতে নামমাত্র সময় লেগেছিল তাঁর। তাঁর কেরিয়ারের লেখচিত্র এতটাই দ্রুত ঊর্ধ্বগামী ছিল যে, যা দেখে হিংসা হত খ্যাতনামী শিল্পীদেরও।
সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করার এ রকমই এক সময়ে খুন হয়ে যান তিনি। খুন হন স্ত্রী অমরজ্যোৎও। এই ঘটনার পর ৩৪ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তাঁর অনুগামীরা আজও শোকে বিহ্বল। কিন্তু পুলিশ সেই খুনের কোনও মীমাংসা করতে পারেনি। আজও হয়তো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁদের খুনিরা।
অমর সিংহের জন্ম লুধিয়ানার ডুগরিতে ১৯৬০ সালে। বাড়ির সবাই তাঁকে ‘দুন্নি রাম’ বলে ডাকতেন। পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী ছিলেন না তিনি। ছোট থেকেই বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রের প্রতি ভালবাসা ছিল অমরের। বড় হয়ে ইলেক্ট্রিশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়নি। বরং বড় হয়ে লুধিয়ানার একটি কাপড়ের কারখানায় কাজে ঢুকেছিলেন। পেশাদার কারও কাছে গান শেখেননি। কিন্তু পরে গান-বাজনা ভালবেসেছিলেন এবং নিজের চেষ্টাতেই হারমোনিয়াম এবং ঢোল বাজানো শিখেছিলেন।
নিজেই গান লিখতেন, নিজেই সুর দিতেন। ১৯৭৮ সালে বন্ধুর কথাতেই তিনি সে সময়ে পঞ্জাবের জনপ্রিয় শিল্পী সুরিন্দর শিন্দার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। প্রিয় বন্ধু কুলদীপ পরসের বাইকে চেপে সুরিন্দরের কাছে গিয়েছিলেন চমকিলা। তখন তাঁর বয়স সবে ১৮। সুরিন্দরেরই একটি গান গেয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন অমর। যা শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সুরিন্দর। সে দিনই চমকিলার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চোখে পড়েছিল তাঁর।
চমকিলাকে নিজের দলে নিয়ে নেন তিনি। প্রথম প্রথম সুরিন্দরের জন্য গান লিখতেন তিনি। কিন্তু পরিবর্তে যা টাকা পেতেন তা দিয়ে সংসার খরচ চলছিল না। এর পরই তিনি নিজের আলাদা গানের দল বানাতে শুরু করেন। প্রথমে প্রিয় বন্ধু কুলদীপকে পাশে নিয়েই মঞ্চে গান গাইতে শুরু করেছিলেন তিনি। জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছতে খুব বেশি সময় নেননি তিনি। নিজের পাকাপোক্ত গানের দলও বানিয়ে নেন অচিরেই।
তিনি গাইতে শুরু করলে সারা মঞ্চ যেন ঝলমল করে উঠত। সে কারণেই তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ‘চমকিলা’। পঞ্জাবিতে ‘চমকিলা’-র অর্থ উজ্জ্বল। অমর সিংহ তখন বিবাহিত। তাঁর দুই মেয়েও রয়েছে। কিন্তু মঞ্চে গান গাইতে গাইতে মন দিয়ে বসলেন তাঁরই সহযোগী অমরজ্যোৎ সিংহকে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর অমরজ্যোৎকে বিয়ে করেন তিনি। অমরজ্যোতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার পর তাঁর কেরিয়ারের আরও উন্নতি হতে থাকে। মঞ্চে দু’জনের জুটি খুব পছন্দ করতেন শ্রোতারা।
সারা পঞ্জাব জুড়েই গান গেয়ে বেড়াতেন তাঁরা। ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ এ রকমই একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে স্ত্রী অমরজ্যোৎকে নিয়ে পঞ্জাবের মেহসামপুরে গিয়েছিলেন তিনি। গাড়িতে দলের বাকিরাও ছিলেন। দুপুর ২টো নাগাদ গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর এবং অমরজ্য়োতের শরীর। আহত হন তাঁর দলের আরও কয়েক জন। বাইকে চড়ে একটি দল তাঁদের উপর প্রকাশ্যেই এই হামলা চালিয়ে চলে যায়।
কেন খুন হতে হয়েছিল তাঁদের? এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। অনেকের মতে, পরিবারের সম্মান রক্ষার্থেই এই খুন। অমরজ্যোতের পরিবারই নাকি ভাড়া করা দুষ্কৃতীদের দিয়ে এই হামলা চালিয়েছিল। অমর সিংহের সঙ্গে অমরজ্যোতের বিয়ে মেনে নেয়নি তাঁর পরিবার। মেয়ে মঞ্চে উঠে গান গাইলে এতে নাকি পরিবারের অসম্মান হচ্ছিল। পরিবারের সম্মান রক্ষার্থেই তাই মেয়ে-জামাইকে খুন করে দেওয়া হয়।
একাংশের মতে, অমর সিংহের গানের কিছু শব্দ অপছন্দ ছিল শিখদের একাংশের। খালিস্তানি আন্দোলনে যা নাকি প্রভাব ফেলতে পারত। সে কারণেও তাঁদের খুন করা হয়ে থাকতে পারে। তদন্তকারীরা এও অনুমান করেছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে খুবই ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অমর সিংহের জন্য অনেকেই অনুরাগী হারাচ্ছিলেন। উপার্জনও কমছিল। তাঁরাও পরিকল্পনা করে খুন করে থাকতে পারেন। তদন্তে এমন একাধিক অনুমান উঠে এসেছে।
কিন্তু কোনও অনুমানই ধোপে টেকেনি তদন্তকারীদের। তাই ৩৪ বছর পরও এহেন এক খ্যাতনামীর খুনের রহস্য অজানাই রয়ে গিয়েছে। কোনও সন্দেহভাজন গ্রেফতারও হয়নি।
পরিচালক কবীর সিংহ চৌধরি তাঁর জীবনী নিয়ে ২০১৮ সালে ‘মেহসামপুর’ নামে একটি মকুমেন্টরি বানিয়েছেন। ইমতিয়াজ আলিও তাঁকে নিয়ে একটি ছবি বানাতে চলেছেন।