অ্যাকশন ছবি হোক বা রোম্যান্টিক ঘরানার ছবি— শাহরুখ খানের ছবি মুক্তি পেলে ‘মিস্’ করতেন না লেহর খান। শাহরুখের নাচের দৃশ্যগুলি অনুকরণ করতেন, শাহরুখের ছবির জনপ্রিয় সংলাপ আওড়াতেন ক্রমাগত। লেহরের মনে অভিনয়ের বীজ প্রথম গেঁথেছিলেন শাহরুখই। কিন্তু সেই শাহরুখের সঙ্গেই যখন একই ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেন তখন সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ‘জওয়ান’-এর অভিনেত্রী।
১৯৯৯ সালে ৪ জুলাই দিল্লিতে জন্ম লেহরের। ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিল প্রাণিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে বিজ্ঞানী হওয়ার। প্রতিটি পরীক্ষায় ভাল ফলও ছিল তাঁর। কিন্তু পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য বিষয়েও আগ্রহ ছিল লেহরের। তা হল শাহরুখের ছবি।
শাহরুখের কোনও ছবি মুক্তি পেলেই তার সংলাপ থেকে শুরু করে নাচের দৃশ্য পর্যন্ত সমস্ত নিমেষের মধ্যে আত্মস্থ করে ফেলতেন লেহর। বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে আবার শাহরুখের মতো অভিনয় নকল করে তিনি মহড়া চালিয়ে যেতেন নিজে থেকেই। কিন্তু শাহরুখের সঙ্গেই যে অভিনয়ের সুযোগ পাবেন তা কি কখনও ভেবেছিলেন?
খেলাধুলো এবং নাচে পারদর্শী ছিলেন লেহর। স্কুলে পড়াকালীন নাচের কোনও অনুষ্ঠান হলেই পারফর্ম করতেন তিনি। এমনকি নাচের বিভিন্ন রিয়্যালিটি শোয়ে অংশগ্রহণও করেছিলেন তিনি।
নাচের রিয়্যালিটি শোয়ে বিজয়ী হওয়ার পর আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে লেহরের। ১১ বছর বয়সে ‘ডেস্টিনি’ নামে একটি শর্ট ফিল্মে অভিনয়ের সুযোগ পান তিনি।
২০১২ সালে বলিপাড়ায় আত্মপ্রকাশ করেন লেহর। নীলমাধব পান্ডার পরিচালনায় ‘জলপরি: দ্য ডিসার্ট মারমেড’ ছবিতে শিশু অভিনেতা হিসাবে অভিনয় করতে দেখা যায় লেহরকে।
‘জলপরি: দ্য ডিসার্ট মারমেড’ ছবিটি মুক্তির পর স্কুলে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যান লেহর। সকলে ভাবতেন যে তিনি অভিনয় নিয়ে কেরিয়ার গড়বেন। কিন্তু লেহর তখনও বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নই বুনে চলেছিলেন।
কিন্তু লেহর তাঁর কেরিয়ার নিয়ে সিদ্ধান্ত বদল করেন ‘জলপরি: দ্য ডিসার্ট মারমেড’ ছবি মুক্তির তিন বছর পর। লীনা যাদবের পরিচালনায় ২০১৫ সালে মুক্তি পায় ‘পার্চড’ ছবিটি। এই ছবিতে রাধিকা আপ্তে, সুরভিন চাওলা, তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রীদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন লেহর।
‘পার্চড’ ছবিতে শিশু অভিনেতা হিসাবে অভিনয় করে বলিপাড়ার নজর কাড়েন লেহর। এই ছবিতে অভিনয় করে বহুল প্রশংসা পাওয়ার পর লেহর বুঝতে পারেন যে অভিনয়কে পেশা হিসাবে বেছে নিলেই তিনি ভাল থাকবেন।
অভিনয় নিয়ে কেরিয়ার গড়তে চলেছেন সে কথা বাবা-মাকে জানান লেহর। তাঁকে যে দিল্লি ছেড়ে নতুন শহরে গিয়ে মানিয়ে-গুছিয়ে নিতে হবে তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন লেহরের বাবা-মা। কিন্তু কন্যার স্বপ্নকেই গুরুত্ব দেন তাঁরা।
দিল্লিতে লেহরের বাবা তাঁর ব্যবসা নিয়ে থেকে যান এবং লেহর তাঁর মায়ের সঙ্গে দিল্লি ছেড়ে চলে যান মুম্বই। ফিল্ম মেকিং নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে মুম্বইয়ের একটি কলেজে ভর্তি হন লেহর।
কলেজে পড়াকালীন বলি পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অভিনয়ের প্রস্তাব পান লেহর। ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছবির প্রথম পর্বে অভিনয়ের জন্য ডাক পান তিনি।
‘পার্চড’ মুক্তির সাত বছর পর আবার বড় পর্দায় অভিনয় করেন লেহর। তা-ও আবার অমিতাভ বচ্চন, রণবীর কপূর, আলিয়া ভট্ট, ডিম্পল কপাডিয়ার মতো দক্ষ তারকাদের সঙ্গে অভিনয় করবেন তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি।
লেহরের প্রিয় অভিনেতা শাহরুখ ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছবিতে ক্যামিয়ো চরিত্রে অভিনয় করবেন জেনে যারপরনাই খুশি হন লেহর। যদিও শাহরুখের সঙ্গে একই দৃশ্যে অভিনয়ের সুযোগ পাননি তিনি।
‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছবিতে রবিনার চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় লেহরকে। ছবিতে গজাস্ত্রধারীর ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেও এই অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে মূল্যবান ছিল।
‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছবির শুটিং শেষ করার পর কলেজের পড়াশোনা শেষ করেন লেহর। লেহর তাঁর কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জন করার পরেও অবশ্য প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি ‘ব্রহ্মাস্ত্র’।
ফিল্ম মেকিং নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর ‘দহন’ ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয়ের সুযোগ পান লেহর। কিন্তু এই ওয়েব সিরিজ়ের শুটিং চলাকালীন তাঁর জীবনে শোকের ছায়া নেমে আসে। এমনকি সে সময় অভিনয় ছেড়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
২০২১ সালে কোভিড সংক্রমণ যখন তুঙ্গে তখন রাজস্থানে ‘দহন’ ওয়েব সিরিজ়ের শুটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন লেহর। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আবহে লখনউতে লেহরের দিদার বাড়িতে যান অভিনেত্রীর বাবা-মা। সেখানে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয় লেহরের পরিবার।
আক্রান্ত হওয়ার পর লেহরের মা সুস্থ হয়ে গেলেও করোনার সঙ্গে লড়াই করতে ব্যর্থ হন লেহরের বাবা। করোনা সংক্রমণের কারণেই মারা যান তিনি। পিতৃশোকে ভেঙে পড়েন লেহর। কোনও রকমে ‘দহন’ ওয়েব সিরিজ়ের শুটিং শেষ করেন তিনি।
লেহর জানান, তাঁর বাবা তাঁকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জোগাতেন। ছবি নিয়ে হোক বা বলিপাড়ার তারকাদের নিয়ে— বাবার সঙ্গেই সব আলোচনা করতেন লেহর। বাবার জন্যই অভিনয়ের অনুপ্রেরণা পেতেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর তাই অভিনয়জগৎ থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন লেহর।
২০২২ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। ছবিটি সফল হলেও তার স্বাদ পাননি লেহর। বাবাকে প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে গিয়ে লেহর তাঁর অভিনয় দেখাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ তিনি আর কোথায় পাবেন? ধীরে ধীরে হতাশা ঘিরে ফেলে লেহরকে।
বাবার মৃত্যুর দু’মাস পর লেহরের কেরিয়ারে নতুন মোড় আসে। বলিপাড়ার জনপ্রিয় কাস্টিং ডিরেক্টর মুকেশ ছাবড়া যোগাযোগ করেন তাঁর সঙ্গে। ‘জওয়ান’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয় লেহরকে।
প্রিয় অভিনেতা শাহরুখের সঙ্গে একই ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান লেহর। কিন্তু কাজ করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ‘জওয়ান’ ছবির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন লেহর। কিন্তু তাঁর মায়ের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত বদল করেন তিনি।
লেহরের মতে, তাঁর বাবার জন্যই তিনি আবার অভিনয় শুরু করেন। কারণ সিনেমার প্রতি লেহরের বাবার ভালবাসা ছিল অগাধ। লেহর বলেন, ‘‘আমি অভিনয় চালিয়ে যাব শুধু বাবার জন্যই। আমি জানি বাবা এতে খুশি হবে। আমাকে দূর থেকেই আশীর্বাদ করবে।’’
‘জওয়ান’ ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যাবে লেহরকে। বড় পর্দার পাশাপাশি ছোট পর্দাতেও নিজের পরিচিতি গড়ে তুলছেন তিনি। ‘কনফেশন্স অফ অ্যান ইন্ডিয়ান টিনেজার’ নামের এক টেলিভিশন সিরিজ়ে অভিনয় করেছেন লেহর।
বিভিন্ন নামী সংস্থার বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেন লেহর। অভিনয়ের পাশাপাশি চিত্রনাট্য লেখা এবং পরিচালনার কাজেও আগ্রহ রয়েছে তাঁর। একটি অ্যানিমেশন স্টুডিয়ো খোলার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।
স্টপ মোশন ভিডিয়ো নিপুণ ভাবে বানিয়ে ফেলতে পারেন লেহর। ভারতে শিশুদের জন্য উন্নত মানের অনুষ্ঠান তৈরি করতে চান তিনি।
ছবি তুলতে এবং ছবি আঁকতে ভালবাসেন লেহর। সমাজমাধ্যমের পাতায় মাঝেমধ্যে তার ছাপও রেখে দেন তিনি। ইতিমধ্যে ইনস্টাগ্রামে লেহরের অনুরাগী সংখ্যা ১৩ হাজারের গণ্ডি পার করে ফেলেছে। বর্তমানে ‘জওয়ান’ ছবির মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছেন লেহর।