তাঁর পরিকল্পনা শুনে এককালে ঠাট্টা করেছিল লোকে। অথচ সেই ব্যবসায়ীর হাতে তৈরি সংস্থা কিনতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল দেশের বড় বড় সব ব্র্যান্ড।
টাটা, আইটিসি, নেসলে— সব্বাই তাঁর ব্র্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সংস্থাটি কেনার জন্য টাটারা সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করতেও পিছপা হয়নি।
ব্যবসায়ীর নাম অজয় গুপ্ত। শূন্য থেকে শুরু করা বলতে যা বোঝায়, সে ভাবেই নিজের সংস্থাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর সংস্থা সস বানায়। আর বানায় চিনা খাবারের প্রয়োজনীয় মশলাপাতি।
বছর ৩০ আগে প্রথম ভাবনাটা মাথায় এসেছিল। ভারতীয়েরা তখন রাস্তার ধারের খাবারে মজে আছে। আর সব রকম খাবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে চিনা খাবার। দোকানেও ইনস্ট্যান্ট নুডল আর রেডিমেড স্যুপ হু হু করে শেষ হচ্ছে। অজয় সেই সময়েই ভেবেছিলেন চিনা খাবার নিয়ে ব্যবসা করার কথা।
অজয় প্রথমেই ঠিক করেন, ভারতীয়েরা যে চিনা খাবার খাচ্ছেন, তার স্বাদে কিসের অভাব রয়েছে সেটি খুঁজে বার করবেন।
তিনি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের রাস্তার ধারের চিনা খাবারের স্টলে পাঠান ফুড টেস্টারদের। এঁরাই খাবারের স্বাদ যাচাই করে অজয়কে জানান, ভারতে বিক্রি হওয়া চিনা খাবারে যদি কিছুর অভাব থেকে থাকে তবে তা হল ভারতীয়ত্ব।
ভারতে বিক্রি হওয়া ওই সমস্ত খাবার ভারতীয়েরা খেলেও তাতে ভারতের কোনও ছোঁয়া নেই। এই ভাবনা থেকেই এক নতুন ধরনের স্বাদ তৈরি করার কথা মাথায় আসে অজয়ের।
ঠিক করেন এমন জিনিস বানাবেন, যাতে রাস্তার ধারের এই স্টলগুলির চিনা খাবারে ভারতীয় স্বাদ খুঁজে পাওয়া যায়। আবার ভারতীয়েরা নিজেদের বাড়িতেও সহজে চিনা খাবার বানাতে পারেন।
চিনের চিং বা জিন সাম্রাজ্যের নামে সংস্থার নাম রাখেন অজয়। তৈরি করেন চিনা খাবার বানানোর তিন রকম সস— সয়া সস, গ্রিন চিলি সস এবং রেড চিলি সস।
কী বিক্রি করবেন, তা তো ঠিক হল। কিন্তু বিক্রি করবেন কাদের কাছে? অজয় তাঁর সসের কথা জানালেন ডিস্ট্রিবিউটরদের। যাঁদের কাছ থেকে জিনিস কেনেন দোকানদারেরা। তাঁদের থেকে সেই জিনিস পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে।
কিন্তু অজয়ের কথা শুনেই মুখের উপর না বলে দিলেন সকলে। তাদের একটাই বক্তব্য, ‘‘এ জিনিস কেউ কিনবে না।’’ শেষে একেবারে ‘ছক্কা হাঁকানো’ বুদ্ধি এল অজয়ের মাথায়।
তিনি তাঁর তৈরি করা সস দিতে শুরু করলেন রাস্তার ধারের চিনা খাবারের দোকানে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। নিখরচায় পেয়ে তাঁরাও ওই সসই ব্যবহার করতে শুরু করেন।
এর পর জনপ্রিয় দোকানগুলির নামে নিজেদের ব্র্যান্ডের নামও দেওয়ার প্রস্তাব দেন অজয়। বদলে তাদের ব্যবহারের সমস্ত সস বিনামূল্যে দিতেন তিনি। লোকে জানতে শুরু করে অজয়ের ব্র্যান্ডের নাম। আর এতেই কাজ হয়।
এক বছরের মধ্যে হাতেনাতে ফল পান অজয়। ১৯৯৫ সালে সংস্থা তৈরি করেছিলেন। ১৯৯৬ সালেই দেখা যায় নাগাল্যান্ড থেকে শুরু করে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সর্বত্র ডিস্ট্রিবিউটররা অজয়ের তৈরি সস চান। ক্রমশ পরিচিতি বাড়তে থাকে ব্র্যান্ডের।
এক বছরের মধ্যেই আড়াই কোটি টাকা দিয়ে নিজস্ব সস বানানোর কারখানা কিনে নেন অজয়। নাসিকে তৈরি সেই কারখানা ছিল ভারতের প্রথম ইন্দো-চাইনিজ় খাবারের উপকরণ বানানোর কারখানা।
ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বড় করতে থাকেন অজয়। চিনা খাবারের মশলার পাশাপাশি আরও একটি সংস্থা তৈরি করে বিক্রি করতে শুরু করেন ইটালি-সহ বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত নানা রকম সস। সঙ্গে তৈরি করেন হাক্কা নুডলসও।
ক্রমশই বাড়িতে বিদেশি খাবার বানানোর উপকরণের একমাত্র ঠিকানা হয়ে ওঠে অজয়ের সংস্থা। বাড়তে থাকে গ্রাহক। ২০১০ সালের মধ্যে অজয়ের চিনা খাবার তৈরির সংস্থার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ পৌঁছয় ১১০ কোটি টাকায়।
তত দিনে সমাজমাধ্যমের রমরমা বেড়েছে। সেখানেও জোরদার প্রচার শুরু করেছে অজয়ের ব্র্যান্ড। কিন্তু অজয়ের মন ভরছিল না তাতেও। অল্পে সন্তুষ্ট হননি তিনি আগেও। এ বারও তাঁর মনে হল প্রচারে খামতি থেকে যাচ্ছে। আরও মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। আরও পরিচিতি তৈরি করতে হবে।
অজয় ভেবে দেখলেন, মানুষকে টানতে হলে বলিউডের গ্ল্যামার দরকার। ভাবামাত্রই কাজে করে দেখালেন অজয়। ২০১৪ সালে বলিউড নায়ক রণবীর সিংহকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বানালেন অজয়। বিজ্ঞাপনে রণবীর হলেন ক্যাপ্টেন রণবীর। পদবিটি বদলে নিলেন অজয়ের সংস্থার নাম দিয়ে। ব্যাস আর যায় কোথায়! প্রকাশ হতে না হতেই ভাইরাল হল সেই বিজ্ঞাপন। আরও জনপ্রিয় হল অজয়ের সংস্থা।
পাঁচ বছরে ১১০ কোটির বার্ষিক আয় বাড়ল তিনগুণ। ২০১৫ সালে অজয়ের সংস্থার উপার্জন বেড়ে হল বছরে ৩৫০ কোটি টাকা। তত দিনে ভারতের ১১টি রাজ্যে দেড় লক্ষ দোকানে পাওয়া যায় তাঁর সংস্থার তৈরি চিনা খাবারের মশলাপাতি।
২০২৩ সালে সংস্থাটির মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০০ কোটি টাকা। অজয়ের সংস্থার তৈরি জিনিস এখন দেশের চার লক্ষ দোকানে পাওয়া যায়। লাভের মাত্রাও অবিশ্বাস্য! মূলধনের অন্তত ২৫ শতাংশ।
অথচ এই অজয়ই যখন চিনা খাবারে ভারতীয় মশলা মিশিয়ে প্রথম ‘দেশি চাইনিজ়’-এর কথা বলেছিলেন, তখন হেসেছিলেন সকলে। ঠাট্টা করে বলা হয়েছিল, কোনও দিনই এমন খাবার হালে পানি পাবে না।
অজয় যদিও সেই সব ঠাট্টাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের বিশ্বাসে অটুট থেকেছেন। আর সে জন্যই বিদেশি পণ্য ছেড়ে অজয়ের সংস্থার তৈরি পণ্যের চাহিদা বেশি বাজারে। তিনি তাঁর জগতের অবিসংবাদী নেতা।
তাঁর তৈরি সংস্থাটি কেনার জন্য প্রস্তাব এসেছিল নেসলে, আইটিসি এবং টাটার তরফে। শেষ পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে টাটার ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়েছে।