এক চুমুকেই শান্তি! স্কচ হুইস্কির পেয়ালা তুলে সুরাপ্রেমীরা এ কথা বলতেই পারেন। তবে ওই এক পেয়ালার জন্য যে পরিবেশের স্বাস্থ্য বিগড়ে যাচ্ছে, তা জানেন কি?
স্কচের সঙ্গে পরিবেশের কী সম্পর্ক? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। সে সূত্র খুঁজে দিতে পারেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। এর জবাব দিতে পারেন স্কচ হুইস্কি তৈরির কারিগরেরাও।
চোখজুড়োনো পরিবেশ ছাড়াও হুইস্কির জন্য বিশ্বখ্যাত স্কটল্যান্ড। মল্টেড রাগী, গম, ভুট্টা বা বার্লি গেঁজিয়ে সে দেশে হাজার হাজার বছর ধরে স্কচ তৈরি হচ্ছে।
হুইস্কি তৈরির প্রক্রিয়ায় সাধারণত একটি বহু ছিদ্রযুক্ত পাটাতনের উপর ওই ধরনের দানাশস্য ছড়িয়ে তা পোড়ানো হয়। তবে সরাসরি নয়। পাটাতনটির নীচে বদ্ধ জলাশয়ের ঘাসমাটির চাপড়া রেখে তাতে আগুন দেওয়া হয়। যাতে ওই দানাশস্যে ‘স্মোকি ফ্লেভার’ আসে। এর পর ওই শস্যগুলি দিয়েই স্কচ তৈরি করা হয়।
বদ্ধ জলাশয়ের চাপড়া পোড়ানোর অর্থ যে বাস্তুতন্ত্রে সরাসরি আঘাত হানা, তা জানেন স্কচ তৈরির বহু কারিগর। তাঁদের অনেকেই পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন। স্কটল্যান্ডের অ্যানাবেল টমাসের কথাই ধরুন না!
এক পেয়ালা স্বাদু স্কচের জন্য যে বাস্তুতন্ত্রকে কতটা খেসারত দিতে হয়, তা জানেন অ্যানাবেল। স্কটল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে তাঁদের পারিবারিক খামারবাড়িতে প্রথম স্কচ তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন ন্যাকনিন ডিল্টিলারির মালকিন। সেটা ২০১৭ সাল। তিন বছর পর বাজারে এসেছিল ন্যাকনিনের স্কচ।
অ্যানাবেল জানিয়েছেন, স্কচ হুইস্কি নিয়ে আমজনতার ধারণা বদলে দিতে চান তিনি। স্বাদু স্কচ তৈরিতে মন দিলেও পরিবেশের ক্ষতি এড়িয়েই তা করতে চান। অ্যানাবেলের কথায়, ‘‘পরিবেশ এবং সুরাপ্রেমীদের পাশাপাশি মুনাফার কথাও যে একই সঙ্গে ভাবা যায়, তা-ই করে দেখাতে চাই।’’
বদ্ধ জলাশয়ের ঘাসমাটির চাপড়া পোড়ালে তার জেরে যে বাস্তুতন্ত্রের উপর বোঝা বাড়ে, তা জানেন অ্যানাবেল। তিনি বলেন, ‘‘ঘাসমাটির চাপড়া পোড়ানোটা খুব একটা কাজের কথা নয়। বদ্ধ জলাশয়গুলি আসলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের খনি। জীববৈচিত্রে ভরপুর ওই জলাশয়ের ঘাসমাটি কেটে পোড়ানো হলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ফের পরিবেশে ফেরত চলে যায়। ফলে জলাশয়ের পাশাপাশি পরিবেশেরও ক্ষতি হয়।’’
অ্যানাবেল যদিও জানেন যে স্কচ হুইস্কিতে ‘স্মোকি ফ্লেভার’ আনতে ওই ঘাসমাটির চাপড়ার বিকল্প নেই। তবে পরিবেশের ক্ষতি এড়াতে তিনি অন্য পথ বেছে নিয়েছেন।
কী ভাবে পরিবেশের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব? অ্যানাবেল জানিয়েছেন, তাঁর সুরা তৈরির কারখানায় বদ্ধ জলাশয়ের ঘাসমাটির চাপড়া ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ।
অ্যানাবেলের মতো একই পথের দিশারী অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ার আর এক হুইস্কি প্রস্তুতকারী সংস্থা বেলগ্রোভ। পিটার বিগনেলির ওই ছোট্ট সংস্থাটি রয়েছে তাসমানিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূলে। ঘাসমাটির চাপড়া বাদ দিয়েও হুইস্কি তৈরি করতে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন পিটার।
হুইস্কি তৈরির কাজে ব্যবহৃত দানাশস্যের জন্য তাঁরা নিজেরাই চাষবাস শুরু করেছেন। হুইস্কি তৈরির সময় অতিরিক্ত খড়কুটো ভেড়ার খাদ্যে কাজে লাগানো হয়। এ ছাড়া, দানাশস্য পোড়ানোর জন্য ঘাসমাটির চাপড়ার বদলে ব্যবহার করেন জীবাশ্ম জ্বালানি।
বেলগ্রোভের হুইস্কিকে স্বাদু করতে অন্য উপায় বার করেছেন পিটার। তাঁর কথায়, ‘‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লোদস ড্রায়ারে খানিক অদলবদল ঘটিয়ে তা দিয়ে স্মোকিং করা হয়। তা ছাড়া, এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে না সরিয়েই কাঁচা শস্য ভেজানো হয়।’’ এ প্রক্রিয়া ‘মল্ট’ করলে হুইস্কি স্বাদু হয় বলেই দাবি পিটারের।
পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন, বদ্ধ জলাশয়গুলি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওই ধরনের জলাশয়ের ঘাসমাটিতে থাকা জীবাণুদের মধ্যে অতি সামান্য অক্সিজেন ঢোকায় জলাশয়ের জৈব পদার্থে পচন ধরতে সময় লাগে। ফলে কার্বন ডাঅক্সাইডে ঠাসা থাকে জলাশয়ের ঘাসমাটি, তা পরিবেশে ফিরে যেতেও সময় নেয়।
বিশ্বের সমস্ত জমির মধ্যে ৩ শতাংশ বদ্ধ জলাশয় রয়েছে। তবে তাতে জঙ্গলের থেকেও দ্বিগুণ কার্বন ডাইঅক্সাইড ঠাসা। পরিবেশবিদদের দাবি, এ ধরনের জলাশয়গুলি ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের ৮৫ শতাংশ পানীয় জলের উৎস। পাশাপাশি, এতে বসবাস করা জীববৈচিত্রও কম নয়।
ব্রিটেনের এক বিশ্ববিদ্যালের ইকোসিস্টেম অ্যান্ড বায়োজিওকেমিক্যাল সাইকলের অধ্যাপক অ্যাঙ্গেলা গালেগো-সালার দাবি, ‘‘বিশ্ব জুড়ে হুইস্কি তৈরির কাজে বদ্ধ জলাশয়ের ঘাসমাটির চাপড়ার ব্যবহার খুবই নগণ্য। তবে বিষয়টি শুধুমাত্র কার্বন ডাইঅক্সাইডেই আটকে নেই। তার থেকে বেশি কিছু।’’
গালেগো-সালা বলেন, ‘‘বদ্ধ জলাশয়ের ঘাসমাটির চাপড়া তুলে ফেললে আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে গোটা জলাশয়টিই ক্ষতির মুখে পড়ে। জীববৈচিত্রে আঘাত হানা হয়, জল এবং কার্বন-চক্রও ভেঙে যায়।’’
ব্রিটেনের ওই পরিবেশবিদের মতে, ‘‘আমাদের অনেকেরই হয়তো হুইস্কি পান করতে দারুণ লাগে। তা করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে কি না, সে সম্পর্কে জেনেবুঝে একটা পথ বেছে নেওয়া প্রয়োজন।’’