২০১৪ সালে চিনের সবচেয়ে ধনী শিল্পপতি ছিলেন জ্যাক মা। শীর্ণদেহী, বেঁটেখাটো মানুষটি আলিবাবা গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাক্তন চেয়ারম্যান। ফোর্বসের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের ধনীতমদের তালিকায় বর্তমানে তাঁর অবস্থান ৬৪ নম্বরে।
বিনিয়োগ, আর্থিক সাফল্য বা ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, ২০২০ সালের শেষের দিকে অন্য একটি কারণে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসেন জ্যাক। আচমকা তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। অক্টোবর মাসে সাংহাইয়ের একটি সমাবেশে শেষ বার তাঁকে দেখা গিয়েছিল। সে দিন চিনের শাসকদলের সমালোচনা শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে। তার পর থেকেই নাকি দীর্ঘ দিন খোঁজ মেলেনি এই চিনা ধনকুবেরের।
জ্যাক মায়ের অন্তর্ধানের খবর বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। জলজ্যান্ত মানুষটি কোথায় গেলেন, তার কোনও হদিসই মিলছিল না। চিনের সরকারের তরফেও এ বিষয়ে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে রহস্য ক্রমেই গাঢ় হয়।
জ্যাক মায়ের অন্তর্ধান চিনের অন্য কয়েকটি অনুরূপ অন্তর্ধানের দিকে আলোকপাত করে। বহির্বিশ্বের নজরে আসে, জ্যাক মা প্রথম নন, অতীতে তাঁর মতো হারিয়ে গিয়েছেন আরও একাধিক ধনকুবের, সমাজের প্রভাবশালীরা।
অন্তর্হিত এই চিনা ধনপতিদের তালিকায় আছেন গুয়ো গুয়াংচ্যাং, ঝৌ চেংজিয়ান, রেন ঝিকিয়াং, শিয়াও জিয়ানহুয়া প্রমুখ। প্রত্যেকেই অত্যন্ত রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। যেন উত্থানের মাঝে আচমকা ডুবে গিয়েছে তাঁদের খ্যাতির তরী।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, অন্তর্হিত ধনকুবেররা কোনও না কোনও ভাবে সরকার তথা চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচনায় সরব হয়েছেন। সরকার বিরোধিতার মাশুল তাঁদের দিতে হয়েছে, দাবি বিশেষজ্ঞদের।
চিনের বিনিয়োগকারী ধনকুবের গুয়ো গুয়াংচ্যাংয়ের অন্তর্ধানের খবর প্রকাশ্যে আসে ২০১৫ সালে। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল গুয়োর। কেউ কেউ তাঁকে ‘চিনের ওয়ারেন বাফেট’ও বলতেন।
তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি দীর্ঘ দিন। সমাজমাধ্যমে কেউ কেউ সে সময় দাবি করেন, গুয়োকে চিনের পুলিশ সাংহাই বিমানবন্দরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই দৃশ্য দেখা গিয়েছে। গুয়ো দীর্ঘ দিন বেপাত্তা থাকার পর ফিরে আসেন। কাজেও যোগ দেন আবার। কিন্তু তাঁর এই অন্তর্ধান নিয়ে কোথাও কাউকে মুখ খুলতে দেখা যায়নি।
২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে সাংহাইয়ের জনপ্রিয় ফ্যাশন সংস্থার মালিক ঝৌ চেংজিয়ানের সঙ্গে আচমকা যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তাঁকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না, কোনও ভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় ঝৌয়ের সংস্থা।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়ায়, একটি দুর্নীতির তদন্তের স্বার্থে ঝৌকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু সবটাই এত গোপনে, যে কাকপক্ষীতেও টের পায়নি। কয়েক সপ্তাহ পর ফিরে আসেন ঝৌ। কিন্তু আচমকা অন্তর্ধান সম্পর্কে কোনও বাক্যব্যয় করেননি।
২০২০ সালে একই কায়দায় আচমকা নিখোঁজ হয়ে যান চিনের আর এক রিয়েল এস্টেট ধনকুবের রেন ঝিকিয়াং। কোভিড অতিমারির সংক্রমণে যখন সারা দেশ ছেয়ে গিয়েছে, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সংক্রমণ পা দিয়েছে বিদেশেও, সেই সময় চিন সরকারের অতিমারি সংক্রান্ত নীতির সমালোচনা করে একটি অনলাইন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন রেন। শুধু তাই নয়, চিনের প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিঙের নাম না করলেও একাধিক বার তাঁকে উদ্দেশ করে ‘জোকার’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন রেন।
কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘ দিনের সদস্য রেনের এই ‘দুঃসাহস’ ক্ষমা করেনি চিন সরকার। দীর্ঘ দিন নিখোঁজ থাকার পর সরকার জানায়, রেন শাসকদল থেকে বহিষ্কৃত। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়। ১৮ বছরের কারাবাসের সাজা হয় রেনের। ঘুষ নেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো কিছু অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল চিন সরকার। তবে অনেকেই বলেন, সরকারের সমালোচনা করার শাস্তিই ভোগ করছেন রেন।
চিনের আর এক বিনিয়োগকারী সংস্থা ‘টুমরো গ্রুপ’-এর প্রধান শিয়াও জিয়ানহুয়া সরকারের কোপে পড়েন ২০১৭ সালে। হংকঙের একটি হোটেল থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ, হুইলচেয়ারে বসিয়ে মুখে কালো কাপড় জড়িয়ে চিনের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা হয় শিয়াওকে। তার পর থেকে জনসমক্ষে তাঁকে আর দেখা যায়নি।
ঝৌ, শিয়াও, রেন কিংবা জ্যাক মায়ের মতো আচমকা অন্তর্হিত প্রভাবশালীদের তালিকায় নবতম সংযোজন বাও ফ্যান। চিনের একটি প্রথম সারির ব্যাঙ্কিং সংস্থার প্রধান তিনি। গত তিন সপ্তাহ ধরে তাঁর হদিস মিলছে না বলে দাবি চিনা এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
বাও ফ্যানের অন্তর্ধানের খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই চিনের শেয়ার বাজারে তাঁর সংস্থার শেয়ারে ধস নেমেছে। সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে বাও কোথায়, কী ভাবে আছেন, তা কেউ জানেন না।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক অ্যারন ফ্রায়েডবার্গের মতে, চিন সরকারের ক্ষমতাকে প্রশ্ন করলে তার পরিণতি কী হতে পারে, জ্যাক মা এবং অন্য চিনা ধনকুবেরদের পরিণতি চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি কখনওই বেসরকারি কোনও সংস্থার হাতে অতিরিক্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে দেয় না। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রভাবশালীরা অর্থের জোরে মাথা তোলার চেষ্টা করলেই তাঁদের ডানা ছেঁটে ফেলা হয়।
চিনে বরাবর কমিউনিস্ট পার্টির একটিই নীতি, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দলের উপরে নয়। দলের বিরুদ্ধে কথা বললে যে কোনও ক্ষমতাবানকেই কোপের মুখে পড়তে হবে। জ্যাক মা কিংবা বাও ফ্যানেরা সে কথাই প্রমাণ করেছেন বারবার।