শনিবার মুম্বইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে মহিলাদের আইপিএলের জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। কিয়ারা আডবাণী, কৃতি শ্যাননদের মতো এক ঝাঁক বলিউড তারকা অনুষ্ঠানে আসর মাতিয়েছেন। সেই সঙ্গে উদ্বোধনের মঞ্চে আরও একজনের উপস্থিতি দর্শকদের চোখ টেনেছে। তিনি মন্দিরা বেদী।
মন্দিরা যেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বনলতা সেন’। বাইশ গজের খেলার সঞ্চালনায় মহিলাকণ্ঠের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই উঠে আসে মন্দিরার নাম। অনেকের মতে, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মহিলা ধারাভাষ্যকার তিনি। নারীর কণ্ঠে এমন গুছিয়ে ক্রিকেটের উপস্থাপনা মন্দিরার পর করতে পেরেছেন হাতেগোনা কয়েক জনই।
ভারতীয় ক্রিকেটের দাপুটে ধারাভাষ্যকার হিসাবেই মন্দিরাকে চেনে ক্রিকেট বিশ্ব। ২০০৩ সালে মহিলাদের বিশ্বকাপে সঞ্চালনার দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। সে সময় তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়।
আইপিএল হোক কিংবা সাধারণ টুর্নামেন্ট, বিশ্বকাপের মঞ্চেও বহু বার নজর কেড়েছেন মন্দিরা। সঞ্চালনা এবং ধারাভাষ্যে তাঁর প্রতিভা বিশ্বের দরবারে প্রশংসা কুড়িয়েছে। ফুটবল, কবাডি খেলার সঞ্চালক হিসাবেও দেখা গিয়েছে তাঁকে।
তবে শুধু ক্রিকেট নয়, খেলার মাঠের বাইরেও মন্দিরার বিচরণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। অভিনয়, ফ্যাশন ডিজ়াইন কিংবা সমাজসেবা এবং নারীকল্যাণমূলক কার্যকলাপ, সর্বত্র তিনি রয়েছেন। বিশেষত নারীবাদী হিসাবে বিভিন্ন মহলে মন্দিরার পরিচিতি রয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েনে খেলার মাঠ থেকে কিছু দিন বিরতি নিয়েছিলেন মন্দিরা। মাইক হাতে ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা, খুনসুটিতে তাঁকে দেখা যাচ্ছিল না। শনিবার মহিলাদের আইপিএলের মঞ্চে মন্দিরাকে দেখে তাই উচ্ছ্বসিত তাঁর ভক্তেরা।
২০২১ সালের ৩০ জুন মন্দিরার স্বামী রাজ কৌশল চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন মন্দিরা।
সমাজমাধ্যমে একাধিক পোস্টে প্রয়াত স্বামীর প্রতি ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন মন্দিরা। রাজের মৃত্যুশোকে যে তিনি ডুবে রয়েছেন, বার বার মনে হয়েছে সে কথাই। বিবাহবার্ষিকী কিংবা স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকীতে সমাজমাধ্যমের দেওয়ালে ফিরে ফিরে এসেছে তাঁদের প্রেমজীবনের স্মৃতি।
রাজের মৃত্যুর পর অন্য অনেকের সঙ্গে শেষযাত্রায় কাঁধ দিতে দেখা গিয়েছিল মন্দিরাকেও। পিতৃতন্ত্রের তথাকথিত অনুশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন স্বামীর দেহের ভার। চোখের জলে ভেসে রাজের শেষযাত্রাতেও ছায়াসঙ্গী হন মন্দিরা।
পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মহিলাদের উন্নয়নের পক্ষে বার বার সরব হয়েছেন মন্দিরা। স্তন ক্যানসার কিংবা এডসের বিরুদ্ধে সচেতনার প্রসারমূলক কর্মসূচিতে একাধিক বার দেখা গিয়েছে তাঁকে। মন্দিরা নিজে দত্তক নিয়েছেন এক শিশুকন্যাকে।
এই দত্তক কন্যাটিকে নিয়েও কম কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়নি মন্দিরাকে। নেটাগরিকদের অনেকে ৪ বছরের তারাকে ‘রাস্তার মেয়ে’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। সমাজমাধ্যমে সে কথা জানিয়েছেন মন্দিরা নিজেই। তিনি জানান, তাঁর দত্তক কন্যাকে কটাক্ষ করে কেউ কেউ লিখেছিলেন, ‘‘কোন বস্তি থেকে একে তুলে এনেছেন?’’ বা ‘‘রাস্তার মেয়েকে এখানে মানাচ্ছে না।’’
মন্দিরার দিকে কটাক্ষ ধেয়ে এসেছিল রাজের মৃত্যুর পরেও। তাইল্যান্ডে ছোটবেলার বন্ধুর জন্মদিন পালন করতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে সুইমিং পুলের জলে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে জলকেলিতে মেতে উঠেছিলেন। সেই ছবি বাঁকা চোখে দেখেন অনেকেই। সমাজমাধ্যমে বয়ে গিয়েছিল কটূক্তির বন্যা।
তবে দত্তক কন্যার পরিচয় হোক কিংবা ভেজা শরীরে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, প্রতি কটাক্ষেই সোজা ব্যাটে খেলেছেন মন্দিরা। সমালোচনা, বৈষম্যের কাছে তিনি কখনও মাথা নিচু করেননি।
অভিনেত্রী হিসাবেও দেখা গিয়েছে মন্দিরাকে। ১৯৯৫ সালে শাহরুখ খানের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিতে একটি চরিত্রে কাজ করেছিলেন তিনি। তার পর হিন্দি এবং তামিল ভাষার একাধিক ছবিতে তাঁকে দেখা গিয়েছে।
বড় পর্দার পাশাপাশি, ছোট পর্দাতেও সমান সাবলীল মন্দিরা। ‘কিঁউ কি সাস ভি কাভি বহু থি’, ‘মহাভারত’-এর মতো জনপ্রিয় ধারাবাহিকে কাজ করেছেন তিনি। তা ছাড়া, ‘ফেম গুরুকুল’, ‘জো জিতা ওহি সিকন্দর’, ‘ইন্ডিয়ান আইডল জুনিয়র’ প্রভৃতি টেলিভিশন শো-তে সঞ্চালনা করেছেন তিনি।
পুত্র বীর এবং কন্যা তারাকে নিয়ে মন্দিরার ভরা সংসার। প্রয়াত স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন তিনি। নারীর অধিকার এবং লিঙ্গসাম্য নিয়ে গলা ফাটানো মন্দিরা কাজে ফিরলেন সেই মহিলাদের খেলার হাত ধরেই। তাঁকে পুরনো মেজাজে খেলার মাঠে দেখতে মুখিয়ে দর্শকেরা।