আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সংস্থার ক্রমবর্ধমান স্টক বিনিয়োগকারী এবং বিশ্লেষকদের বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই সাতটি প্রযুক্তি সংস্থা সম্মিলিত ভাবে ‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ নামে পরিচিত।
‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ শব্দটি সাম্প্রতিক কালে আমেরিকান স্টক মার্কেটে আধিপত্য বিস্তারকারী প্রযুক্তি সংস্থাগুলির একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়। ক্লাউড কম্পিউটিং, ইকমার্স, সমাজমাধ্যম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বৈদ্যুতিক যান-সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি খাতের একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে এই সংস্থাগুলি।
আমেরিকা তথা বিশ্বের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করা প্রযুক্তি দুনিয়ার তাবড় সাতটি সংস্থাকে সকলে একডাকেই চেনেন। এরা হল অ্যালফাবেট, অ্যামাজ়ন, অ্যাপ্ল, মেটা, মাইক্রোসফ্ট, এনভিডিয়া এবং টেসলা। যাদের একযোগে এই বিশেষণে ডাকা হয়।
হঠাৎ করে কেনই বা অদ্ভুত নামকরণ করা হল এদের? কোথা থেকে এল এই বিশেষণটি? কে প্রথম এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন?
‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ এই শব্দবন্ধটি স্টকের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন মাইকেল হার্টনেট। মাইকেল হলেন ‘ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা’র আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ কৌশল গবেষণা দলের প্রধান। ২০২৩ সালের মে মাসে তিনি ওয়াল স্ট্রিটের আধিপত্য বজায়কারী সাতটি সংস্থাকে একযোগে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এই নামটি দিয়েছিলেন।
‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’, এই নামটি এসেছে ষাটের দশকের একটি জনপ্রিয় হলিউডি সিনেমা থেকে। স্টিভ ম্যাককুইন, ইউল ব্রাইনার এবং চার্লস ব্রনসন অভিনীত এই সিনেমায় ভাড়া করা সাত বন্দুকধারীর গল্প বলা হয়েছিল যাঁরা বহিরাগত দস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি শহরকে বাঁচিয়ে দেয়।
এই সংস্থাগুলি ধারাবাহিক ভাবে নিজেদের স্টকের লভ্যাংশ ধরে রেখে নিজেদের বৃহত্তর বাজারকে ছাড়িয়ে যায়। নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে এই শব্দবন্ধটি জনপ্রিয় হয়েছিল।
শেয়ার বাজারের প্রেক্ষাপটে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে এই সাতটি সংস্থাকে বাজারের পুঁজির রক্ষক এবং চালিকা শক্তি হিসাবে ধরা হয়েছিল।
আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারে এস অ্যান্ড পি ৫০০ হল স্টক মার্কেট ইনডেক্স, যা আমেরিকার সর্ববৃহৎ সংস্থাগুলির লেনদেন ও পুঁজি সংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করে। ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন স্টকগুলি বাজার সূচকগুলিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে, বিশেষ করে এস অ্যান্ড পি ৫০০-এর ক্ষেত্রে।
স্টিভ জবস, স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন মিলে ১৯৭৬ সালে তৈরি করেছিলেন তথ্যপ্রযুক্তির অন্যতম সংস্থা অ্যাপ্ল। ১৯৭৬ সালে আকারে ছোট, কম জটিল এবং সস্তা কম্পিউটার তৈরির লক্ষ্য নিয়ে বাজারে নামে অ্যাপ্ল। মাত্র চার বছর, অর্থাৎ ১৯৮০ সালের মধ্যে এই সংস্থা বিশ্বের অন্যতম পরিচিত সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
এর ঠিক এক বছর আগে ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল মাইক্রোসফ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিশ্ববাজারে অ্যাপ্লের প্রতিদ্বন্দ্বী এই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান সংস্থাও বটে। বিল গেটস এবং পল অ্যালেন মিলে তৈরি করেন সফ্টঅয়্যার সংস্থাটি।
১৯৯৪ সাল জেফ বেজোসের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে ইকমার্স সংস্থা অ্যামাজ়ন। ২০২১ সালে অ্যামাজ়নের চিফ এগ্জ়িকিউটিভ অফিসার (সিইও)-র পদ ছাড়েন বেজোস। যদিও সংস্থার চেয়ারম্যান থাকবেন তিনি। সংস্থার সবচেয়ে বেশি শেয়ারও রয়েছে তাঁরই নামে।
জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগ্লের মূল সংস্থাটি হল অ্যালফাবেট। ১৯৯৮ সালে ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন এর প্রতিষ্ঠা করেন।
২০০৩ সালে টেসলা মোটর্স নামে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধনকুবের ইলন মাস্ক টেসলার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও। ইলনের এই সংস্থা অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক গাড়ি, গাড়ির ব্যাটারি এবং সৌরশক্তি চালিত বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে। বৈদ্যুতিক গাড়ির নকশাও তৈরি করে টেসলা।
আমেরিকার বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থা ফেসবুক ইনকর্পোরেশনের নাম বদলে হয় মেটা। ২০০৪ সালে মার্ক জ়াকারবার্গ প্রতিষ্ঠা করেন এই সংস্থাটির। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ওকুলাস, হোয়াট্সঅ্যাপের মতো জনপ্রিয় অ্যাপ ছাড়াও ভার্চুয়াল প্রযুক্তিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে জ়াকারবার্গের সংস্থাটি।
চলতি বছরের জুনে বৃহত্তম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসাবে এনভিডিয়া আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৯৯৩ সালে পথচলা শুরু করে এই সংস্থাটি। বর্তমানে ইকমার্স সংস্থা অ্যামাজ়ন এবং বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা মেটার মোট বাজারি মূলধনের চেয়ে বেশি সম্পত্তি রয়েছে এনভিডিয়ার কাছে। এরা প্রধানত গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) এবং মোবাইলের জন্যে চিপ তৈরি করে।
২০২০ সালে এই সাতটি সংস্থার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্বব্যাপী অতিমারির টানাপড়েনের মধ্যেও বাজার স্থিতিশীতা বজায় রাখতে পেরেছে। কোভিডকালে ও পরবর্তী কালে ওয়ার্ক ফ্রম হোম, হট ডেস্কিং বা অনলাইন পরিষেবাগুলির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় অ্যামাজ়ন, মাইক্রোসফ্ট এবং অ্যাপ্লের মতো সংস্থাগুলির আয় এবং স্টকের দাম বেড়েছে। এই প্রবণতা ২০২২ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
বহু বিশ্লেষক এবং অর্থনীতিবিদই ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে আশাবাদী। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ব্যবসায় বাড়বৃদ্ধি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগ, মেটাভার্সের মতো নতুন প্রযুক্তির বিকাশ সেই সম্ভাবনার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।