জীবনের মোড়ঘোরানো দিনটি মনে পড়ে? কোন সাল বা মাস ছিল সেটি? জবাব দিতে গিয়ে অনেকেই ঘেমেনেয়ে একশা হতে পারেন। তবে নিজের জীবনের সেই দিনটি এখনও স্পষ্ট মনে রয়েছে নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা লিন স্লেটারের।
কে লিন স্লেটার? আমজনতার কাছে অচেনা ঠেকতে পারে। তবে ফ্যাশন মডেলিংয়ের জগতের সঙ্গে সামান্য পরিচয় থাকলেও এ প্রশ্নের জবাব দিতে বেশি ক্ষণ ভাবতে হবে না।
নিউ ইয়র্কের ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজসেবা এবং আইনের অধ্যাপক লিন সমাজকর্মীও বটে। তবে তাঁর অন্য এক পরিচয়ও রয়েছে। ফ্যাশন জগৎকে নিয়ে বহু প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছেন ৬৮ বছরের এই মহিলা। লিনের ছকভাঙা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিচ্ছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞাও।
ইচ্ছে করে ফ্যাশন মডেলিংয়ের দুনিয়ায় পা রাখেননি লিন। তা আচমকাই ঘটেছিল তাঁর জীবনে। মোড়ঘোরানো সে দিনটি স্পষ্ট মনে রয়েছে লিনের। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। নিউ ইয়র্কের অভিজাত ম্যানহাটন এলাকায় এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সে সময় আচমকাই তাঁর জীবন ‘ওলটপালট’ হয়ে যায়।
ফ্যাশন উইক-এর অঙ্গ হিসেবে ম্যানহাটনের লিঙ্কন সেন্টারের একটি শো চলছিল। বন্ধুকে নিয়ে তা দেখতেই তাঁর জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন লিন। তবে ওই শো দেখতে আসা বিদেশি ফোটোগ্রাফারেরা লিনকে দেখামাত্রই তাঁর ফোটো তুলতে শুরু করে দেন। কেতাদুরস্ত লিনকে দেখে তাঁরা ভেবেছিলেন, নিশ্চয়ই তিনি ফ্যাশন জগতের কোনও হোমড়াচোমড়া ব্যক্তিত্ব। সে সময় লিনের বয়স ষাট পেরিয়ে গিয়েছে।
লিনের উপর ক্যামেরার ঝলকানি দেখে নিউ ইয়র্কে বেড়াতে আসা লোকজনও পটাপট তাঁর ফোটো তুলতে শুরু করেন। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি লিনকে। পরিচয়ের ভুলে রাতারাতি ফ্যাশন মডেল হয়ে যান ষাটোর্ধ্ব লিন। বদলে যায় তাঁরা জীবনও। তবে সাফল্যের এ কাহিনিতে নিজের মশলাপাতিও ঢেলেছেন তিনি। তবে সে কাহিনিতে ঢোকার আগে ফের চলে যাওয়া যাক অধ্যাপক লিনের জীবনে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সে ঘটনার আগে থেকেই অবশ্য ফ্যাশন নিয়ে একটি ব্লগ লেখা শুরু করেছিলেন লিন। কাকতালীয় ভাবে তাঁর নাম, ‘অ্যাক্সিডেন্টাল আইকন’। তবে ফ্যাশন জগতের হোমড়াচোমড়া হওয়ার কোনও ইচ্ছেই ছিল না লিনের। বরং কর্মজীবন শেষে একটা বই লেখার ইচ্ছে ছিল।
তবে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনা লিনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। রাতারাতি লিনের ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ হয়ে উঠতে শুরু করে ফ্যাশন পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা। ওই ঘটনার মাসখানেকের মধ্যে লিন জায়গা করে নেন বিশ্ববন্দিত ‘ডাউনটাউন ম্যাগাজিন’-এ। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে লিনের ব্লগের পাঠকসংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল।
আচমকা শুরু হলেও এর পর নতুন পথে রওনা দেন লিন। ফ্যাশন মডেল হিসেবে তাঁর ধ্যানধারণাও চমকে দেওয়ার মতো।
ফ্যাশন নিয়ে গতেবাঁধা ধারণার বদলে তাতে স্বকীয় ভাবনার ছাপ রেখেছেন লিন। তাঁর মতে, ফ্যাশনদুরস্ত পোশাকআশাক আদতে নিজেকে প্রকাশ করার একটি মাধ্যম মাত্র। ফ্যাশন মডেল বলতেই যে হাড় জিরজিরে স্বল্পবয়সি ‘সুন্দরী’র চেহারা ভেসে ওঠে, তাতেও হানা দিয়েছে লিনের বলিরেখা ভরা মুখ। পাকা চুলের এই বৃদ্ধার মুখে ঢাউস আকারের ভারী রোদচশমাও তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
নিজের বয়সকে লুকিয়ে রাখতে চাননি লিন। রূপটানের পরত চাপিয়ে ‘সুন্দরী’ হওয়ার চেষ্টাও করেননি। বরং নিজের শরীর, তা সে যেমনই হোক না কেন, তাকে ফ্যাশন মডেল হিসেবে মেলে ধরেছেন। প্রতিটি দেহমনই যে সুন্দর— বহুচর্চিত এ ধারণাকে নিজের মতো করে বলতে চেয়েছেন লিন।
ফ্যাশন মডেল মানেই যে কমবয়সি যুবক-যুবতী, সে ধারণাতেও আঘাত হেনেছেন লিন। তিনি বলেন, ‘‘ফ্যাশন জগতে বয়সের কোনও মাপকাঠি নেই। আমার কথা হল—আমাকে বলবেন না যে এটা এই নিয়ম বা সেটা ওই নিয়মে চলে।’’
ফ্যাশনদুরস্ত জামাকাপড় যে নিজ সত্তার পরিচয় বহন করে, তা-ও মনে করেন লিন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মনে হয় পোশাকআশাকের আপনার সত্তাকে প্রকাশ্যে এনে দিতে পারে। কাগুজে শব্দের থেকেও বেশি কার্যকর ভাবে নিজেকে প্রকাশ করা যায়।’’
যে বয়সে অনেকেই অবসরের আনন্দ উপভোগ করেন, সে বয়সেই ফ্যাশন মডেলিংয়ের দুনিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন লিন। ইনস্টাগ্রামে এখনও পর্যন্ত তাঁর ৭ লক্ষ ৫৯ হাজারের বেশি ‘ফলোয়ার’-এর মধ্যে অনেকেই কমবয়সি। তাঁদের অনেকে আবার লিনের মতো ‘কুল’ হতে চান। লিনের কথায়, ‘‘কমবয়সিরা বার্ধক্যের ধারণাকে অস্বীকার করেন না। তাঁরা এমন ভাবে বুড়ো হতে চান না, যা যুগ যুগ ধরে তাঁদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে।’’
ফ্যাশন মডেল হিসেবে এ ভাবেই নিজের ‘নিয়ম’ চালু করেছেন লিন। প্রথাগত নয়। বরং নিময়হীনতাই যেন লিনের জগতে নতুন নিয়ম!