আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৌলতে মস্তিষ্কের জটিল থেকে জটিলতর রোগও সারিয়ে তোলেন চিকিৎসকেরা। কখনও ওষুধেই হয় কাজ হাসিল, কখনও রোগ সারাতে মস্তিষ্কে কাটাছেঁড়া করতে হয়।
কিন্তু মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের একটি চিকিৎসা পদ্ধতি কয়েক দশক আগে উঠে এসেছিল বিতর্কের কেন্দ্রে। মস্তিষ্কের অন্যতম বিতর্কিত এই অস্ত্রোপচার পদ্ধতির নাম লোবোটমি সার্জারি।
১৯৩০-এর দশকে আমেরিকায় জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল লোবোটমি সার্জারি। এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের জটিল রোগের চিকিৎসা করা হত। চিকিৎসা পদ্ধতিও ছিল অত্যন্ত জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
লোবোটমির আর এক নাম লিউকোটমি। এটি এক প্রকারের সাইকোসার্জারি। স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া-সহ নানাবিধ মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসায় এক সময় এই সার্জারির একচেটিয়া প্রয়োগ করা হত।
আমেরিকা জুড়ে বহু মানুষ এই চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। লোবোটমি প্রয়োগ করা হয়েছিল হাজার হাজার রোগীর উপর। কেউ সুস্থ হয়েছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে মিলেছিল কাঙ্ক্ষিত ফল। তবে অনেক ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হয়ে গিয়েছিল।
লোবোটমির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অনেকেই আরও জটিল মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতেন। মৃত্যুও হত বহু মানুষের। সেই কারণেই এই শল্যচিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে এত বিতর্ক। ষাটের দশকে আমেরিকায় লোবোটমি নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
কী ভাবে অস্ত্রোপচার করা হয় লোবোটমিতে? এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর মাথার খুলি ফাটিয়ে ঘিলুর নির্দিষ্ট অংশ বার করে আনা হয়। কখনও কখনও হয় ঘিলুর অদলবদলও।
মূলত দু’টি প্রক্রিয়ায় লোবোটমি প্রয়োগ করা হত। প্রথম প্রক্রিয়া অনুযায়ী, শল্যবিদ রোগীর খুলির দু’দিকে দু’টি ছিদ্র করতেন। তার পর লিউকোটোম নামের একটি যন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কের টিস্যু কেটে ফেলতেন।
দ্বিতীয় প্রক্রিয়া অনুযায়ী, রোগীর চোখের কোটরে যন্ত্র প্রয়োগ করতেন চিকিৎসক। তার পর হাড়ের পাতলা আস্তরণের মধ্যে দিয়ে যন্ত্রটিকে ঘিলু পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হত। একই পদ্ধতিতে কেটে ফেলা হত মস্তিষ্কের টিস্যু।
দাবি, এই চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর মনের ভাব বদল করা যায়। মানসিক ভারসাম্যহীন যে রোগী কখনও হাসেন, কখনও কেঁদে ফেলেন, কখনও আবার তীব্র আক্রোশে ফুঁসতে থাকেন, সেই রোগীকে নিমেষে শান্ত করে দেয় লোবোটমি।
চরিত্রগত ভাবে যিনি রাগী, লোবোটমির মাধ্যমে তাঁকে শান্তশিষ্ট, ক্রোধহীন করে তোলা যায়, দাবি লোবোটমি প্রয়োগ করা চিকিৎসকদের। তবে বিরুদ্ধ মত বলে, লোবোটমি আসলে রোগীর অনুভূতি শক্তিকে নষ্ট করে। রোগী জড়তায় আক্রান্ত হন। প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
লোবোটমির আবিষ্কর্তা পর্তুগিজ স্নায়ুবিশারদ অ্যান্টোনিয়ো এগাস মনিজ়। ১৯৪৯ সালে লোবোটমি সংক্রান্ত আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই পুরস্কার নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।
প্রথম থেকেই একদল চিকিৎসক এবং স্নায়ু বিশেষজ্ঞ লোবোটমির বিরোধিতা করে এসেছেন। তা সত্ত্বেও আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া-সহ একাধিক দেশে ধীরে ধীরে এই চিকিৎসা পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
পরিসংখ্যান বলছে, পুরুষের চেয়ে মহিলা রোগীদের উপর বেশি প্রয়োগ করা হত লোবোটমি। ১৯৫১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আমেরিকার লোবোটমি প্রযুক্ত রোগীর ৬০ শতাংশই মহিলা।
যে বছর লোবোটমির আবিষ্কর্তা নোবেল পান, তার ঠিক পরের বছরই এই চিকিৎসা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় সোভিয়েত রাশিয়ায়। এর পর একে একে ইউরোপের অন্যান্য দেশও রাশিয়ার পথে হাঁটে।
১৯৬৭ সালে আমেরিকায় শেষ বার লোবোটমি প্রয়োগ করা হয়েছিল। চিকিৎসক ওয়ালটার ফ্রিম্যানের সেই অস্ত্রোপচারে মৃত্যু হয়েছিল রোগীর। তার পর থেকে আমেরিকায় আর এই অস্ত্রোপচার করা হয়নি।
লোবোটমির পর রোগীদের তাৎক্ষণিক এবং প্রায় আবশ্যিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল খিঁচুনি। এ ছাড়া, অস্ত্রোপচারের পর রোগী সারা ক্ষণই যেন বিভ্রান্ত হয়ে থাকতেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হারাতেন আত্মসংযমও। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর অস্বাভাবিক হারে মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যেত লোবোটমির পর।
পরবর্তী কালে লোবোটমি নিয়ে খুঁটিনাটি গবেষণা, পর্যবেক্ষণ করেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের দাবি, এই অস্ত্রোপচার মানুষের ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধির বিনিময়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা করে। অস্ত্রোপচারের পর রোগী কার্যত অনুভূতিশক্তিহীন হয়ে পড়েন।
বলা হয়, লোবোটমি চলাকালীনই মৃত্যু হয়েছে অনেক রোগীর। কেউ কেউ আবার পরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। অনেক রোগীর মস্তিষ্ক স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে লোবোটমির সাফল্য যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। এই অস্ত্রোপচারের পর মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে বাড়ি যেতে পেরেছেন। কেউ কেউ হাসপাতালে থাকলেও হয়ে উঠেছেন নিয়ন্ত্রণযোগ্য। আবার কোনও কোনও রোগী লোবোটমির পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছেন। ১৯৪০ সালে লোবোটমিতে মৃত্যুর হার ছিল ৫ শতাংশ।
লোবোটমিতে পারদর্শী চিকিৎসক ফ্রিম্যান তাঁর এক রোগীর বর্ণনা করে জানান, অস্ত্রোপচারের পর ২৯ বছর বয়সি মহিলা ঝিনুকের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। জড়তা যেন গ্রাস করেছিল তাঁকে। তিনি হাসতেন, অলস ভাবে বসে থাকতেন, খালি পাত্র থেকে অবিরাম কাপে চা ঢালতেন।
লোবোটমি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর মানসিক রোগের চিকিৎসায় ওষুধের উপরেই ভরসা রাখা হয়েছে। ওষুধ দিয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করা হয়। ওষুধ ব্যর্থ হলে শেষ অস্ত্র হিসাবে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কেউ কেউ। তবে লোবোটমির প্রয়োগ হয় না আর।
বিশ শতকেই বিপুল সমালোচনার মুখে পড়েছিল লোবোটমি। স্নায়ুচিকিৎসার একটি জার্নালে লোবোটমি সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘‘লোবোটমির ইতিহাস সংক্ষিপ্ত হলেও ধ্বংসাত্মক। এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। হিংসাত্মক এই অস্ত্রোপচারে দাসত্বের কালিমা লেগে রয়েছে।’’