সোমবার দুপুরে নবান্নে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, বুধবার মন্ত্রিসভায় রদবদল হবে। সেই রদবদলই হল বুধ-বিকেলে। রাজ্যের অপসারিত মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই মমতা চাইছিলেন, ‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’র লোকজনকে সরকার পরিচালনায় নিয়ে আসতে। তবে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সাধন পান্ডে মারা গিয়েছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেলে। তাঁদের দফতরগুলো প্রায় খালি পড়ে রয়েছে। আমার পক্ষে এতগুলো দফতর দেখা সম্ভব নয়। তাই আমরা মন্ত্রিসভায় একটা ছোট রদবদল করছি।’’ এই রদবদলে নতুন মন্ত্রী হলেন অনেকে। মন্ত্রিত্ব হারালেনও কয়েকজন। কারা তাঁরা?
উদয়ন গুহ: বামফ্রন্ট আমলে কৃষিমন্ত্রী কমল গুহর ছেলে উদয়ন বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে এসেছিলেন। কমল বামফ্রন্টের শরিক দল ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রভাবশালী নেতা হিসাবে দীর্ঘদিন দিনহাটার বিধায়ক ছিলেন। উদয়নেরও রাজনীতিতে হাতেখড়ি সেই ফরোয়ার্ড ব্লক দিয়েই। ২০০৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ফরোয়ার্ড ব্লকের হয়ে দিনহাটায় প্রথম প্রার্থী হন উদয়ন। কিন্তু তৃণমূল প্রার্থী অশোক মণ্ডলের কাছে পরাজিত হন। হেরে গিয়ে তাঁরই দলের একাংশের বিরুদ্ধে অর্ন্তঘাতের অভিযোগ এনেছিলেন উদয়ন।
২০১১ সালে আবার দিনহাটা কেন্দ্রে সিংহ চিহ্নে বামফ্রন্টের প্রার্থী হন উদয়ন। নির্বাচনে জিতে বিধায়কও হন। কিন্তু বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিএম-সহ ফব নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় তাঁর। এমনিতেও কোচবিহার জেলা ফরোয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে তাঁর কোনওকালেই সুসম্পর্ক ছিল না। দূরত্ব চরমে পৌঁছলে ২০১৬ সালে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূলে যোগদান করেন উদয়ন। ওই একই বছরে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে দিনহাটা কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন প্রায় ২১ হাজার ভোটে। ২০২১ সালের নির্বাচনেও দিনহাটায় তৃণমূলের প্রার্থী হন উদয়ন। তাঁর বিপরীতে প্রার্থী হন বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক। সেই নির্বাচনে নিশীথের কাছে ৫৭ ভোটে হেরে যান তিনি। তবে বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের নির্দেশে নিজের সাংসদ পদ রাখতে নিশীথ বিধায়ক পদ ছাড়ার পর দিনহাটায় উপনির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটে জিতে তৃতীয়বারের জন্য বিধায়ক হন উদয়ন। তাঁকে মন্ত্রিসভায় পূর্ণমন্ত্রী করে আনলেন মুখ্যমন্ত্রী।
তাজমুল হোসেন: উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধি হিসাবে রাজ্যের মন্ত্রিসভায় এলেন তাজমুল হোসেন। মুখ্যমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী হলেন তাজমুল। উদয়নের মতোই মালদহের হরিশচন্দ্রপুর থেকে দু’বারের বিধায়ক তাজমুও প্রাক্তন ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা। উত্তরবঙ্গের এই নেতা ফরোয়ার্ড ব্লকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছিলেন। ২০১১ সালে ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী হিসাবে জিতে প্রথম বার বিধায়ক হন তাজমুল। বিরোধী শিবিরের নেতা হিসাবে তৃণমূল সরকারকে বার বার প্রশ্নের মুখে ফেলে বিধানসভায় নাস্তানাবুদ করতেন তিনি। তবে ২০১৬ সালে দূরত্ব সরিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি।
২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে হরিশচন্দ্রপুরের তাজমুল পরাজিত হন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে হরিশচন্দ্রপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েই জিতে বিধানসভায় ফেরেন তাজমুল। তবে শাসকদলের বিধায়ক হয়েও দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন করে বিতর্কও তৈরি করেন তাজমুল।
বাবুল সুপ্রিয়: মন্ত্রিসভায় বাবুলের জায়গা পাওয়া প্রত্যাশিতই ছিল। রাজ্য মন্ত্রিসভায় পূর্ণমন্ত্রী হলেন তিনি। ২০১৪ সালে আচমকাই উল্কার মতো রাজ্য রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেন বাবুল। বাবা রামদেবের সুপারিশে আসানসোল কেন্দ্রে বিজেপির টিকিট পান তিনি। প্রথম বারেই তৃণমূলের প্রার্থী দোলা সেনকে পরাজিত করে সাংসদ হন। পরিচিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্নেহধন্য হিসাবে। প্রথম বার জিতেই কেন্দ্রে মন্ত্রী হন। তবে প্রতিমন্ত্রী। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী মুনমুন সেনকে হারিয়ে দ্বিতীয় বার আসানসোলের সাংসদ হন বাবুল। দ্বিতীয় বারও কেন্দ্রে মন্ত্রী হন। প্রতিমন্ত্রী।
বাবুলের ‘মোহভঙ্গ’ হয় ২০২১-এ। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাবুল টালিগঞ্জে দাঁড়িয়ে হেরে যান অরূপ বিশ্বাসের কাছে। কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয় বাবুলকে। ঘটনাচক্রে, আসানসোল লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে মাত্র দু’টিতে জয় পায় বিজেপি। দলের একাংশ সে কারণে বাবুলকে ‘দায়ী’ করেছিলেন। তবে বাবুল-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, তিনি টালিগঞ্জে নিজের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদ থেকে সরানোর পর প্রকাশ্যেই বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজনীতি ছাড়ার কথা জানান বাবুল। তবে গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর সবাইকে কার্যত চমকে দিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেন বাবুল। পরে বালিগঞ্জের বিধায়ক তথা মন্ত্রী সু্ব্রত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে সেখানে উপনির্বাচন হলে তৃণমূলের প্রার্থী করা হয় বাবুলকে। ২০ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতে বিধায়ক হন বাবুল।
স্নেহাশিস চক্রবর্তী: স্নেহাশিস হুগলি জেলার রাজনীতিতে পরিচিত মুখ। তৃণমূলের মুখপাত্র হিসাবে তাঁকে প্রায়শই বিভিন্ন চ্যানেলের বিতর্কে তাঁকে দেখা যায়। মদন মিত্র যুব কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন স্নেহাশিসকে হুগলি জেলার যুব তৃণমূলের সভাপতি করেছিলেন। সেখান থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি স্নেহাশিসকে। ২০১১ সালে প্রথমবার জাঙ্গিপুর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। জিতওছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনে ওই একই কেন্দ্রে পর পর তিন বার জিতে স্নেহাশিস নিজের উপর দলের আস্থা বাড়িয়েছেন।
২০২১ সালে স্নেহাশিসকে তৃণমূলের শ্রীরামপুর লোকসভার সাংগঠনিক জেলা সভাপতি করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক রদবদলে শ্রীরামপুর এবং হুগলি— দুই সাংগঠনিক জেলা মিশিয়ে একটি সাংগঠনিক জেলা করার পর স্নেহাশিসকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন জল্পনা শুরু হয়, ‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’র নেতা হিসাবে পরিচিত স্নেহাশিস পূর্ণমন্ত্রী হিসাবে জায়গা পেলেন মন্ত্রিসভায়।
পার্থ ভৌমিক: তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার রাজনীতিতে মুকুল রায়ের ‘অতি-ঘনিষ্ঠ’ নেতা হিসাবে পরিচিত তৃণমূল নেতা পার্থ ভৌমিক। এক সময়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতিও হন পার্থ। পরে ২০১১ সালে নৈহাটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথম বারের জন্য বিধায়ক হন। পার্থ সুবক্তা, ঠান্ডা মাথার রাজনীাতিক বলেই পরিচিত। তিনি পরিচিত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আস্থাভাজন’ বলেও।
পার্থ পর পর তিন বার নৈহাটি থেকে জিতেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পরিষদীয় দলের সচিব পদও দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। নৈহাটির তিনবারের বিধায়ক সেই পার্থকে আনা হল রাজ্য মন্ত্রিসভায়। নতুন মন্ত্রিসভায় পূর্ণমন্ত্রী হলেন পার্থ। দলীয় নেতৃত্বের আশা, ‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’র পার্থ মন্ত্রী হওয়ায় সরকার উপকৃত হবে।
প্রদীপ মজুমদার: রদবদলের পর বাংলার মন্ত্রিসভায় পূর্ণমন্ত্রীর জায়গা পেলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি দফতরের প্রধান উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার। ভোটের রাজনীতিতে প্রথম দিকে দেখা না গেলেও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রদীপকে দুর্গাপুর পশ্চিম কেন্দ্রের প্রার্থী করেন দলনেত্রী মমতা। কিন্তু তিনি পরাজিত হন।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে আবার ওই একই কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়। তবে এ বার আর নিরাশ হননি প্রদীপ। ভোটে জেতার পর দুর্গাপুর পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক হন। মন্ত্রী যে-ই হোন না কেন, প্রদীপের পরামর্শ মেনেই রাজ্যের কৃষি দফতরের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিপ্লব রায়চৌধুরী: আদি তৃণমূলের ‘অন্যতম যোদ্ধা’ হিসাবে পরিচিত বিপ্লব রায়চৌধুরী তাঁর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির জন্য দলের অন্দরে খ্যাত। ষাটের দশকের শেষে মেদিনীপুর জেলা থেকে বিপ্লবের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। ১৯৬৮-’৬৯ নাগাদ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির হাত ধরে ছাত্র পরিষদের সদস্য হন এই বর্ষীয়ান নেতা। বহুবার বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েও তিনি অনেকদিন পর্যন্ত জয়ের মুখ দেখেননি।
১৯৯৬ সালে কোলাঘাট কেন্দ্র থেকে প্রথমবার কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন বিপ্লব। এখনও পর্যন্ত চার বারের বিধায়ক বিপ্লব ১৯৯৮ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগদান করেন। ২০০১ সালেও ভোটে জিতে বিধায়ক হন তিনি। কিন্তু হেরে যান ২০০৬ সালে। তবে ২০১১ সালে বিধানসভায় প্রত্যাবর্তন হয় বিপ্লবের। কিন্তু ২০১৬ সালে পাঁশকুড়া পূর্ব কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়ে আবার পরাজিত হন তিনি। জিতে ফেরেন ২০২১ সালে। চতুর্থ বারের জন্য বিধায়ক নির্বাচিত বিপ্লব পূর্ব মেদিনীপুর জেলার রাজনীতিতে বরাবর অধিকারী পরিবারের ‘বিরোধী’ হিসাবেই বিপ্লব পরিচিত। মুখ্যমন্ত্রীর নতুন মন্ত্রিসভায় স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী হলেন বিপ্লব।
সত্যজিৎ বর্মণ: রাজ্যের মন্ত্রিসভায় রদবদলের পর প্রতিমন্ত্রী হলেন সত্যজিৎ বর্মণ। চল্লিশের কোঠা পার করা তৃণমূল নেতা সত্যজিতের বাংলার রাজনীতিতে আগমন ২০০১ সালে। প্রথম জীবনে কংগ্রেসের সদস্য হলেও ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের পর তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রায়গঞ্জ ২ নম্বর ব্লক থেকে জিতে উত্তর কর্মাধ্যক্ষ হন বিশ্বজিৎ।
বর্তমানে রায়গঞ্জ ২ নম্বর ব্লকের তৃণমূল সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমলের চেয়ারম্যান সত্যজিৎ ২০২১ সালে হেমতাবাদ কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথম বার বিধায়ক হন। নতুন দায়িত্বের জল্পনা নিয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘দিদি যদি আমাকে বুথ সভাপতি হয়ে থাকতে বলেন, তা হলে আমি বুথ সভাপতি হয়েই থাকব। দিদি যা আদেশ দেবেন, সেটাই আমার জন্য শেষ কথা।’’