দীর্ঘ অপেক্ষার পর বৃহস্পতিবার (১১ অগস্ট) রাখিবন্ধনের দিন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল আমির খান ও করিনা কপূর খান অভিনীত ‘লাল সিংহ চড্ডা’। আন্তর্জাতিক স্তরে সাড়া ফেলা ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর চিত্রনাট্যে অনুপ্রাণিত এই ছবিতে ভারতের সংস্কৃতি কেমন ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহী সিনেমাপ্রেমীরা।
তবে, কোনও হলিউড ছবির চিত্রনাট্যের হিন্দি রূপান্তরে আমিরের অভিনয় এই প্রথম নয়। এর আগেও প্রচুর হলিউড রিমেক ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে বলিউডের ‘পারফেকশনিস্ট’কে।
১৯৯১ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় গুলশন কুমার প্রযোজিত ‘দিল হ্যায় কে মানতা নেহি’ ছবিটি। এই ছবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মহেশ ভট্ট। মহেশ-কন্যা পূজার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন আমির। বক্স অফিসে হিটও করেছিল এই ছবি।
তবে, রোম্যান্টিক-কমেডি ঘরানার এই ছবির গল্পে ১৯৩৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট’ ছবির মূল চিত্রনাট্যের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। পরে ‘দিল হ্যায় কে মানতা নেহি’ ছবিটির তামিল রিমেক ‘কড়াই রোজাভে’ এবং কন্নড় রিমেক ‘হুদুগাতা’ বানানো হয়।
ঠিক তার পরের বছর ‘জো জিতা ওহি সিকন্দর’ মুক্তি পায়। আমিরের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী পূজা বেদী। এই ছবিতে একটি বিশেষ চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন আমিরের ভাই ফয়জল খানও।
কমেডি-ড্রামায় পরিপূর্ণ এই ছবিটির চিত্রনাট্য ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ব্রেকিং আওয়ে’ ছবি থেকে অনেকটাই অনুপ্রাণিত। কিন্তু এই প্রসঙ্গে পরিচালক মনসুর খান জানান, এই হলিউড ছবির বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। প্রেক্ষাপটের কিছু অংশে মিল থাকলেও ছবিদু’টি পুরোপুরি আলাদা।
‘হম হ্যায় রাহি পয়্যার কে’ ছবিটি ১৯৯৩ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আমির খান ও জুহি চাওলা। মহেশ ভট্ট পরিচালিত ছবিটি বক্স অফিসে সুপারহিট হয়। জুহিকে সেই সময় ‘বক্স অফিস কুইন’ বলেও সম্বোধন করা হত।
এই ছবির মূল চিত্রনাট্যের সঙ্গে হলিউডের রোম্যান্টিক-কমেডি ঘরানার ছবি ‘হাউসবোট’-এর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘হাউসবোট’। তবে, এই ছবির হলিউড রিমেক বলে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোথাও ঘোষণা করেননি পরিচালক মহেশ। হিন্দি ছবি হিট করার পর এর অনুকরণে ‘ভলে মাভায়া’ নামে তেলুগু রিমেকও তৈরি করা হয়।
১৯৯৫ সালে অ্যাকশন-থ্রিলার ঘরানার ‘বাজি’ ছবিতে আমির খান ও মমতা কুলকার্নিকে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে। আশুতোষ গোয়াড়িকর এই ছবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ‘লগান’-এর আগে এই ছবির মাধ্যমে পরিচালক ও অভিনেতা জুটি বাঁধে। যদিও ‘বাজি’র চিত্রনাট্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
অনেকাংশের দাবি, এই ছবিতে ১৯৮৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ডাই হার্ড’ ছবির অনুকরণের ছাপ পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, ‘র্যাম্বো’, ‘পয়েন্ট ব্রেক’ এর মতো ছবির মূল গল্পের সঙ্গেও মিল রয়েছে ‘বাজি’ ছবিটির।
দিলীপ শঙ্করের পরিচালনায় ১৯৯৫ সালেই মুক্তি পায় ‘আতঙ্ক হি আতঙ্ক’ ছবিটি। আমির ও জুহিকে আবার এই ছবিতে একসঙ্গে কাজ করতে দেখা যায়। আমির, জুহি-সহ এই ছবিতে অভিনয় করেন সকলের প্রিয় ‘থালাইভা’ ওরফে রজনীকান্ত।
অনেকের মতে, ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্লাসিক ক্রাইম ঘরানার ‘দ্য গডফাদার’-ছবির মূল চিত্রনাট্যের স্পষ্ট ছাপ ধরা পড়ে। এই ছবিতে বড় মাপের অভিনেতারা কাজ করলেও বক্স অফিসে চূড়ান্ত ভাবে ফ্লপ করে।
একই বছরেই আমির খান অভিনীত ‘অকেলে হম অকেলে তুম’ ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। অভিনেত্রী মনীষা কৈরালাকে আমিরের বিপরীতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে। রোম্যান্টিক ড্রামা ঘরানার এই ছবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মনসুর খান।
তবে, এই ছবির পোস্টার থেকে ছবির মূল গল্প— সবই হলিউডের অনুপ্রেরণায় তৈরি। ১৯৯৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘স্লিপলেস ইন সিয়াটল’ ছবির পোস্টার লক্ষ করলেই বোঝা যায়, ‘অকেলে হম অকেলে তুম’ ছবিটির পোস্টার অবিকল অনুকরণ করা হয়েছে।
ছবির গল্পের সঙ্গেও একটি হলিউড ছবির মিল রয়েছে। ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’ ছবির অনুকরণে হিন্দি ছবিটি বানানো হয়।
১৯৯৮ সালে বিক্রম ভট্টের পরিচালনায় ‘গুলাম’ ছবিটি মুক্তি পায়। আমির খান ও রানি মুখোপাধ্যায় একসঙ্গে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, এই ছবিটি ‘কব্জা’ ছবির হিন্দি রিমেক। দশ বছর পর সঞ্জয় দত্ত অভিনীত ছবিটি সিনেমাজগতে আবার ফিরিয়ে আনা হবে।
কিন্তু, ‘কব্জা’ ছবিটিও ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ নামে একটি হলিউড ছবির অনুপ্রেরণায় বানানো হয়েছে। এলিয়া কাজান পরিচালিত এই ছবিটি ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায়। ঘটনাচক্রে, এই ছবির ছাপ ‘গুলাম’-এও দেখা যায়।
আমির খান অভিনীত ‘মন’ ছবিটি ১৯৯৯ সালে মুক্তির পরে রোম্যান্টিক ঘরানার ছবি হিসাবে দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়। ইন্দ্র কুমার পরিচালিত এই ছবিতে আমিরের সঙ্গে মনীষা কৈরালা এবং শর্মিলা ঠাকুরও অভিনয় করেন। বিশেষ চরিত্রে রানি মুখোপাধ্যায় ও অনিল কপূরকেও অভিনয় করতে দেখা যায়।
‘মন’ ছবির চিত্রনাট্য ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অ্যান অ্যাফেয়ার টু রিমেম্বার’ নামের হলিউড ছবির চিত্রনাট্য থেকে অনুপ্রাণিত।
২০০৬ সালে মুক্তি পেলেও আজও ‘রং দে বসন্তি’ ছবিটি দর্শকদের প্রিয় ছবির মধ্যে একটি। শুধু আমির নন, ওয়াহিদা রহমান, সোহা আলি খান, অতুল কুলকার্নি, আর মাধবন-সহ বলিউডের বহু তারকা এই ছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৪৮ সালে ‘অল মাই সন্স’ এবং ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জিসাস অব মন্ট্রিওল’— হলিউডের এই দু’টি ছবি থেকে অনুপ্রেরিত হয়ে ‘রং দে বসন্তি’ বানানো হয়।
‘রং দে বসন্তি’র সঙ্গে একই বছরেই মুক্তি পায় আমির ও কাজল অভিনীত ‘ফনা’ ছবিটি। এ ছাড়াও ঋষি কপূর, কিরণ খের, তব্বু এই ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন।
পরিচালক কুণাল কোহলি এই ছবির দ্বিতীয় ভাগ বানানোর সময় হলিউড ছবি ‘আই অব দ্য নিডল’ (১৯৮১) এবং কোরিয়ান ছবি ‘শিরি’র ছাপ রাখার চেষ্টা করেছেন।
২০০৬ সালে ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ‘দ্য প্রেস্টিজ’ ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবির চিত্রনাট্য বিজয়কৃষ্ণ আচার্যকে অনুপ্রাণিত করে। এই ছবির প্রভাবও পড়ে পরিচালকের কাজে।
বলিউডে বাণিজ্যিক ভাবে সফল ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘ধুম’ সিরিজ। ২০১৩ সালে ‘ধুম’ ছবির তৃতীয় পর্বে আমির খানকে দ্বৈতচরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়।
মূল গল্প অনুযায়ী, এই ছবির শেষে কাহিনি এক নতুন মোড় নেয়। নোলান পরিচালিত ‘প্রেস্টিজ’ ছবির অনুকরণেই নিজের ছবিতে এই বদল আনেন বিজয়।
শুধু হলিউড থেকেই নয়, দক্ষিণী সিনেমার অনুকরণে বানানো হিন্দি রিমেক ছবিতেও আমিরকে অভিনয় করতে দেখা যায়। ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গজনী’ ছবিটি একই নামের একটি তামিল ছবির রিমেক।
তবে, এই ছবিতে হলিউডেরও ছাপ পাওয়া যায়। ২০০০ সালে নোলান পরিচালিত ‘মেমেন্টো’ ছবির মূল কাহিনিরও মিশ্রণ লক্ষ করা যায়।