মুদ্রাস্ফীতি, এবং তা থেকে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সঙ্কট। তার কোপ রাজনীতিতে এবং শেষ পর্যন্ত সমাজের সর্বক্ষেত্রে। গত তিন মাসে এই ভাবেই ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতেও চলছে মুদ্রাস্ফীতি। সেখানেও কি একই সমস্যা হতে পারে? শ্রীলঙ্কা থেকে ঠিক কী কী শিক্ষা নিতে পারে ভারত?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির কারণ জানতে হবে। বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে এই প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়।
শেষের এই চরম সঙ্কটের কারণ সাম্প্রতিক একটি ধাক্কা। শ্রীলঙ্কার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বদলই দেশটিকে দেউলিয়া হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে।
একটা বড় কারণ অবশ্যই শ্রীলঙ্কার সরকারের মাত্রাছাড়া ঋণ নেওয়ার প্রবণতা। যা দেশের গড় উৎপাদন ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
ঋণ নিতে নিতে তার ধরনও কালক্রমে বদলাতে হয়েছে। বিশেষ সুবিধা এবং সুদে ছাড় পাওয়া ঋণের সীমা অতিক্রম করে ফেলে শ্রীলঙ্কা। ফলে তার পর বাণিজ্যিক ঋণ নিতে হয়। যার সুদের হার অনেক বেশি। ঋণ শোধের মেয়াদও কম।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের ভ্রান্ত নীতি। রাজাপক্ষে সরকার ২০১৯ সালে দেশে বিভিন্ন করের উপর বড় মাপের ছাড় ঘোষণা করেছিল। ভোটের আগে প্রচারে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজাপক্ষে। যা কার্যকর করার পর টান পড়ে রাজকোষে।
শ্রীলঙ্কার মূল উপার্জনের ক্ষেত্র ছিল পর্যটন। ২০১৯ সালের ইস্টারের সময় শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাস এবং তৎপরবর্তী অতিমারি পরিস্থিতি তাতেও থাবা বসিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির সঙ্গে যদি আমাদের দেশের পরিস্থিতির তুলনা করা হয় তবে আমরা আপাতত সুরক্ষিত। কেন?
ভারতেও মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা সরকার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার কিছু দিন আগে সে দেশেও এমন হয়েছিল। কিন্তু ভারতের আপাতত ‘শ্রীলঙ্কা’ হওয়ার আশঙ্কা নেই।
ভারতে আপতত ৬০ হাজার কোটি ডলারের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার রয়েছে। যার দৌলতে আগামী এক বছরের জন্য বিদেশি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কোনও চিন্তা নেই।
তবে গত আট বছরে ভারতের গৃহীত ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। ২০১৩ সালে যেখানে ৪০ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের ঋণ ছিল ভারতের, সেখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২১ সালে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
বাইরের দেশ থেকে করা ঋণ আর দেশের গড় উৎপাদনের অনুপাত করলে দেখা যাবে ভারত সেই অনুপাতে উন্নতিই করেছে। এই অনুপাত আট বছর আগের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২.৪ শতাংশে।
দেশের বাজারে অন্যতম বড় সমস্যা মূল্যবৃদ্ধি। ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধিতে ভুগছে প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রও। কিন্তু দুই দেশের পার্থক্যটা আকাশ আর পাতালের।
এ দেশে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা থাকলেও তা নিয়ে সরকার পদক্ষেপ করেছে। তা ছাড়া আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো প্রথম শ্রেণির উন্নত দেশেরও সমস্যা মূল্যবৃদ্ধি।
আর ভারত যে হেতু উন্নয়নশীল দেশ, তাই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে এখনই বড় দুশ্চিন্তা নেই বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ। পাশাপাশি মনে করা হচ্ছে, অতিমারির ধাক্কা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারলে দেশের শিল্পোৎপাদনও অনকেটাই বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে অর্থনীতির পালে বাতাস লাগবে।
ডলারের নিরিখে টাকার দাম কমেই চলেছে। তবে এর মধ্যেও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। প্রথমত, ডলারের নিরিখে দাম কমলেও পাউন্ড বা অন্য মুদ্রাগুলির প্রেক্ষিতে টাকার পারফরম্যান্স ভালই। দ্বিতীয়ত টাকার দাম কমায় দেশের রফতানির ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেছে।
ভারতের যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামো রয়েছে, তাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির অনেকটাই নির্ভর করে সরকারের উপর। মজবুত সংসদীয় গণতন্ত্র থাকায় যে কোনও সরকার চাইলেই মর্জিমাফিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এর এখানেই প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য।
তবে এখনই দুশ্চিন্তা না থাকলেও মনে রাখতে হবে আত্মনির্ভরতাই উন্নয়নশীল দেশকে বাঁচতে সাহায্য করে। আর আত্মনির্ভর হতে গেলে উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। ভারত যদি শ্রীলঙ্কা হতে না চায় তবে আগে পরনির্ভরতায় রাশ টানতে হবে। কমাতে হবে আমদানি। বিদেশ থেকে ঋণগ্রহণও কমাতে হবে। আর বৃদ্ধি করতে হবে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার।