তিরিশের দশকে এ দেশের হাতেগোনা মহিলারাই টেনিস কোর্টে পা রাখতেন। তবে সেই দশকেই প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে উইম্বলডনের ম্যাচ জিতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন লীলা রাও। বিয়ের পর যিনি তাঁর নাম-পদবির পাশে জীবনসঙ্গীর ‘দয়াল’ পদবিটিও জুড়ে নিয়েছিলেন। তবে লীলা যে শুধুমাত্র টেনিসের কোর্টেই ঝড় তুলেছেন, তা নয়।
টেনিস খেলা ছাড়াও লীলা ছিলেন একধারে সংস্কৃতজ্ঞা, লেখিকা, মঞ্চাভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী, পর্বতোরোহী-সহ নানা ক্ষেত্রে দক্ষ। যদিও ডিজ়িটাল মাধ্যমের যুগেও স্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছেন তিনি।
উইম্বলডনের কোর্টে জয়ের সময় আরও এক ‘নজির’ গড়েছিলেন ভারতীয় টেনিসের ইতিহাসে ঢুকে পড়া লীলা। যে সময় হাতেগোনা ভারতীয় মহিলারা শাড়ি পরে টেনিস কোর্টে নামতেন, সে সময় উইম্বলডনের ম্যাচে নড়াচড়ার সুবিধায় স্কার্ট পরে খেলতে নেমেছিলেন তিনি। তাতে উন্মুক্ত ছিল তাঁর দু’পায়ের অনেকাংশ। চিরাচরিত নিয়মের উল্টো পথে হেঁটে সে ছিল লীলার নিঃশব্দ বিপ্লব।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লীলার জন্ম ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন বম্বে প্রেসিডেন্সিতে। বাবা রাঘবেন্দ্র রাও ছিলেন নামজাদা চিকিৎসক। মা ক্ষমা রাওয়ের নামের আগে জুড়ে ছিল ‘পণ্ডিতা’ উপাধিটি। সেকালে সংস্কৃত সাহিত্যের নামকরা মুখ ক্ষমা ছিলেন খ্যাতনামী কবি এবং নাট্যকার।
প্রথাগত শিক্ষালাভের জন্য কোনও দিন স্কুলে যাননি লীলা। বরং তাঁর পড়াশোনা চলত বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে। ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি।
এককালে ওই ফ্রান্সেই শিল্পকলার শিক্ষালাভ করেছেন তিনি। পরে প্যারিসেই শিক্ষকের কাছে বেহালা বাজানোর মুনশিয়ানা আয়ত্ত করেন লীলা। সে দেশে যাতায়াতের সময় থেকেই মঞ্চাভিনয়ে আগ্রহ জন্মায়।
টেনিস কোর্টে পা রাখার আগে তিন বছর বয়স থেকে নাচের তালিম নিয়েছেন তিনি। যদিও গোড়ায় তা ছিল শারীরিক দুর্বলতা কাটানোর মাধ্যম মাত্র। কারণ, শৈশবে ম্যালেরিয়ার আক্রান্ত হওয়ায় অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন লীলা।
মায়ের দেখাদেখি টেনিসে আগ্রহ। ক্ষমার কাছেই টেনিসে হাতেখড়ি হয়েছিল লীলার। কুড়ির দশকে হাতেগোনা যে ক’জন ভারতীয় মহিলা টেনিস কোর্টে নেমেছিলেন, ক্ষমা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯২৭ সালে বম্বে প্রেসিডেন্সি হার্ড কোর্ট চ্যাম্পিয়নশিপে সিঙ্গলস খেতাব জিতেছিলেন ক্ষমা।
মায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে নানা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন উইম্বলডন বা ফরাসি ওপেনের কোর্টে দাপিয়ে বেড়ানো ৪ ফুট ১০ ইঞ্চির লীলা। কুড়ি এবং তিরিশের দশকে এ দেশ জুড়ে নানা প্রতিযোগিতায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। ১৯৩১ সালে অল ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর আরও ছ’বার সে খেতাব দখল করেছিলেন।
লীলার টেনিস জীবনের উজ্জ্বল মুহূর্ত এসেছিল ১৯৩৪ সালে। সে বছর প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে উইম্বলডনের প্রথম রাউন্ডে জয় ছিনিয়ে নেন তিনি। ওই ম্যাচে লীলার প্রতিপক্ষ ছিলেন ব্রিটেনের গ্র্যাডিস সাউথওয়েল।
গ্ল্যাডিসের সঙ্গে খেলতে নেমে প্রথম সেটটি ৪-৬ গেমে খুইয়েছিলেন লীলা। তবে পরের সেটে তীব্র লড়াই করে ম্যাচে ফিরে আসেন তিনি। ফল ছিল ১০-৮। তৃতীয় তথা চূড়ান্ত সেটে সহজেই (৬-২) জিতে ম্যাচ মুঠোয় পুরে নেন লীলা।
উইম্বলডনের দ্বিতীয় রাউন্ডে অবশ্য ইদা আদামফের কাছে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেন লীলা। ফ্রান্সের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লীলার লড়াইয়ে খামতি ছিল না। তবে তিন সেটের ম্যাচে ইদার পক্ষে ফলাফল দাঁড়ায় ৩-৬, ৭-৫ এবং ৪-৬।
পরের বছর উইম্বলডনে ফিরলেও প্রথম রাউন্ডে ইভলিন ডিয়ারম্যানের কাছে স্ট্রেট সেটে হারেন লীলা। উইম্বলডনের আগে সে বছর ফরাসি ওপেনের দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিলেন তিনি। সিঙ্গলসের মতোই ডাবলস (১৯৩১ ও ’৩২ সাল) এবং মিক্সড ডাবলসেও (’৩২ সাল) ফরাসি ওপেনে নেমেছিলেন লীলা। যদিও দু’ক্ষেত্রেই প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিয়েছেন।
টেনিস কোর্টে ভারতের পতাকা তুলে ধরা লীলা নানা ক্ষেত্রেই প্রতিভার ছাপ রেখেছেন। সংস্কৃত সাহিত্যকে আধুনিকতার ছোঁয়া দেওয়া ক্ষমার মতোই তাঁর মেয়েও এই ভাষার বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মণিপুরী এবং ভরতনট্টম নৃত্যের উপর সংস্কৃত এবং ইংরেজি ভাষায় একাধিক বই লিখেছেন লীলা। অন্য দিকে, পেশাদার নৃত্যশিল্পী হিসাবে রসিকজনের নজর কেড়েছেন।
ভারতীয় নৃত্য এবং নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে লীলার লেখা ‘নাট্য চন্দ্রিকা’ হোক বা ভরতনট্টমের নানা ক্রমান্বয় সম্পর্কিত ‘নৃত্য মঞ্জরী’— লেখিকার ভূমিকায়ও সফল তিনি। ১৯৫৮ সালে ‘এলএ টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় সাহিত্যকারদের মধ্যে ‘নাট্য চন্দ্রিকা’ই হল প্রথম বই যা আমেরিকার কংগ্রেসের পাঠাগারে ঠাঁই পেয়েছিল।
তিরিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত দেশের নানা নৃত্যশৈলী নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেই গবেষণার ফসল ছিল পাঁচটি বই। ওই বইগুলিতে নৃত্যশৈলীর বিবরণের বোঝানোর জন্য ছবিতে ক্যামেরার সামনে ‘পোজ়’ও দিয়েছেন।
‘উইন্ডসর ডেইলি স্টার’-এর কাছে একটি সাক্ষাৎকারে লীলা বলেছিলেন, ‘‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মন্দিরগুলিতে ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছিলেন আমার পূর্বপুরুষেরা, তা (এই বইগুলিতে) আঁকার মাধ্যমে আনতে চাই আমি।’’
গবেষণার ফাঁকে ১৯৪৩ সালে হরীশ্বর দয়ালের সঙ্গে ঘর বাঁধেন লীলা। হরীশ্বর রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আবার ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসেও কর্মরত ছিলেন। ষাটের দশকে নেপালের ভারতীয় দূতাবাসে কাজ করার সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন লীলা। সে সময় থেকেই পর্বতারোহণের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয় তাঁর।
হরীশ্বরের সঙ্গে নেপালে বসবাসের সময় দেশীয় শিল্প এবং স্থাপত্য নিয়েও লেখালেখি করতেন লীলা। অন্য দিকে পাহাড়ের প্রতি তাঁর টানের কথাও শুনিয়েছেন ‘হিমালয়ান জার্নালে’।
টেনিসে নজির গড়লেও ট্রেকিংই কি তাঁকে সবচেয়ে আনন্দ দিয়েছে? প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে এভারেস্টের খুম্বু অঞ্চলের থ্যাংবোচে মঠে গিয়েছিলেন লীলা। ওই মঠে যাওয়ার জন্য ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমার জীবনের স্বপ্নপূরণ হল।’’
লীলার বৈচিত্রময় জীবন নিয়ে এখন আর সংবাদমাধ্যমে বিশেষ লেখালেখি নজরে পড়ে না। ১৯৭৫ সালে তাঁর সম্পর্কে শেষ বার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র একটি প্রতিবেদনে। সে বছর ফ্রান্সে লীলার আঁকা প্রদর্শিত হয়েছিল।