MP Vyapam Scam

‘রহস্যমৃত্যু’ একের পর এক সাক্ষীর! নাম জড়ায় বহু নেতা-মন্ত্রীর, নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি আগেও দেখেছিল দেশ

ভারতের ইতিহাসে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির নজির বিরল নয়। এই ধরনের দুর্নীতির অন্যতম উদাহরণ মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম দুর্নীতি। দেশের আইনশৃঙ্খলার ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে আছে ব্যাপম।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:৩৩
Share:
০১ ২৫
All you need to know about India’s Biggest Educational & Recruitment Fraud of Madhya Pradesh

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সম্প্রতি বিস্তর জলঘোলা হচ্ছে। কলকাতা হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে বৃহস্পতিবার ২০১৬ সালের এসএসসিতে নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট।

০২ ২৫
All you need to know about India’s Biggest Educational & Recruitment Fraud of Madhya Pradesh

বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ জানিয়েছে, পুরো প্রক্রিয়ায় কারচুপি করা হয়েছে। ওই নিয়োগপ্রক্রিয়ার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।

Advertisement
০৩ ২৫
All you need to know about India’s Biggest Educational & Recruitment Fraud of Madhya Pradesh

সেই সঙ্গে প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি (আদতে ২৫,৭৫২) বাতিল করে জানানো হয়েছে, নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। যাঁরা অন্য সরকারি চাকরি ছেড়ে ২০১৬ সালের এসএসসির মাধ্যমে স্কুলের চাকরিতে যোগদান করেছিলেন, তাঁরা চাইলে পুরনো কর্মস্থলেও ফিরে যেতে পারবেন বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

০৪ ২৫

তবে ভারতের ইতিহাসে এই ধরনের দুর্নীতির নজির বিরল নয়। এই ধরনের দুর্নীতির অন্যতম উদাহরণ মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম দুর্নীতি। দেশের আইনশৃঙ্খলার ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে আছে এই ব্যাপম।

০৫ ২৫

মূলত সরকারি চাকরিতে নিয়োগ এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, নামী প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল ব্যাপমে। ১৯৯০ সাল থেকে এই দুর্নীতির জাল বিস্তার হয়েছিল। যার কথা ফাঁস হয় ২০১৩ সালে এসে।

০৬ ২৫

ব্যাপম হল মধ্যপ্রদেশ প্রফেশনাল এগ্‌জ়ামিনেশন বোর্ড (এমপিপিইবি)। এই বোর্ডের অন্য নাম ‘ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডল’, সংক্ষেপে ব্যাপম। এটি মধ্যপ্রদেশ সরকার দ্বারা গঠিত একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিষ্ঠান, যা রাজ্যের বিভিন্ন পরীক্ষা এবং সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করে।

০৭ ২৫

ডাক্তারি পরীক্ষা এবং রাজ্য সরকারের খাদ্য, শিক্ষা, পুলিশ, বন দফতরে চাকরির পরীক্ষা-সহ ব্যাপম আয়োজিত মোট ১৩টি পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ, অযোগ্য হয়েও চাকরিপ্রার্থী বা পরীক্ষার্থীরা মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে সহজেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছিলেন। দুর্নীতির জাল বিস্তৃত ছিল অনেক গভীর পর্যন্ত।

০৮ ২৫

কোন কোন পথে দুর্নীতি হয়েছে ব্যাপমে? অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে মূল প্রার্থীর জায়গায় অ্যাডমিট কার্ড বদলে পরীক্ষায় বসতেন অন্য কেউ। মেধাবী ছাত্র কিংবা উচ্চ প্রতিষ্ঠিত কোনও চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ানো হত। মিলত অনেক নম্বর।

০৯ ২৫

এ ছাড়া, পরীক্ষাকেন্দ্রে টাকার বিনিময়ে আসন সাজানো হত। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পাশে বসানো হত পরীক্ষার্থীদের, যাতে একে অন্যের খাতা দেখে উত্তর লিখতে পারেন। পরীক্ষাশেষে কখনও কখনও মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রীর সঙ্গে উত্তরপত্র বদলেও নেওয়া হত।

১০ ২৫

কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার এত কিছুর দরকার হত না। পরীক্ষার্থীরা যে উত্তর সম্বন্ধে নিশ্চিত, তা লিখতেন। বাকি খাতা সাদা রেখে দিতেন। সংশ্লিষ্ট আধিকারিক এবং পরীক্ষক তাঁকে প্রয়োজনীয় নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দিতেন। এ সব ক্ষেত্রে খাতাটি এক বার আরটিআই করানো হত। তখন খাতা হাতে নিয়ে ইচ্ছেমতো উত্তর লিখে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

১১ ২৫

প্রতি বছর ৩০ লক্ষের বেশি পরীক্ষার্থী ব্যাপম আয়োজিত পরীক্ষায় যোগ দিতেন। অভিযোগ, তাঁদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিলেন টাকা দেওয়া ভুয়ো পরীক্ষার্থী। ব্যাপম কেলেঙ্কারির তদন্তে ক্রমে জড়িয়ে পড়ে নেতা, মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক, পুলিশ এবং চিকিৎসকের নাম।

১২ ২৫

ব্যাপমের পরীক্ষাগুলির বিরুদ্ধে নব্বইয়ের দশক থেকেই টুকটাক অভিযোগ জমা পড়ছিল। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই সেগুলিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করা হয়েছিল। ২০০০ সালে পরীক্ষায় কারচুপির অভিযোগে প্রথম এফআইআর দায়ের করা হয়। ব্যাপমকে ঘিরে যে বড়সড় দুর্নীতির জাল বিছিয়ে ছিল, তা ২০০৯ সালের আগে স্বীকারই করা হয়নি।

১৩ ২৫

২০০৯ সালে ব্যাপমের একটি প্রাক্‌-মেডিক্যাল পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগে প্রথম মধ্যপ্রদেশ সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি ২০১১ সালে রিপোর্ট জমা দেয় । দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন শতাধিক মানুষ। ২০১৫ সালের জুন মাসের মধ্যে ব্যাপম-কাণ্ডে গ্রেফাতারির সংখ্যা ছাড়ায় ২০০০।

১৪ ২৫

ব্যাপম কেলেঙ্কারির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হল, এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের কেউই সে ভাবে সাজা ভোগ করেননি। অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই কেউ জামিন পেয়ে গিয়েছেন, কেউ বা রহস্যজনক ভাবে পুলিশের হেফাজতেই মারা গিয়েছেন। বহু মৃত্যু দেখেছে ব্যাপম। দিনের পর দিন আরও জটিল হয়েছে রহস্য।

১৫ ২৫

২০১৩ সালে ইনদওর পুলিশ প্রাক্‌-মেডিক্যাল পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে হাতেনাতে ধরে ২০ জন ভুয়ো পরীক্ষার্থীকে। তাঁদের সূত্রেই তদন্তকারীদের জালে ধরা পড়েন দুর্নীতি চক্রের অন্যতম মাথা জগদীশ সাগর। অভিযোগ, বহু পরীক্ষার্থীর থেকে টাকা নিয়ে তাঁদের চাকরি পেতে সাহায্য করেছেন তিনি। কয়েক বছরে হয়ে উঠেছেন বিপুল সম্পত্তির মালিক।

১৬ ২৫

জগদীশের গ্রেফতারির পর একে একে ধরা পড়েন সঞ্জীব শিল্পকার, সুধীর রাই, সন্তোষ গুপ্ত, তরঙ্গ শর্মা-সহ দুর্নীতির অন্য মাথারা। কেউ ২৬ লাখ, কেউ ৩ কোটি— চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে এঁরা এক এক জন এক এক রকম টাকা দাবি করতেন।

১৭ ২৫

ব্যাপমে জড়িত অভিযোগে ২০১৪ সালে গ্রেফতার করা হয় বিজেপি নেতা তথা মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মাকে। শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগেও তাঁর বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ ছিল। তাঁর অধীনে কাজ করা ওপি শুক্ল, সুধীর শর্মাদের মতো শিক্ষা দফতরের অন্য আধিকারিকেরাও হাজতে যান।

১৮ ২৫

অপসারিত আইপিএস অফিসার থেকে শুরু করে ব্যাপমের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, আধিকারিক, অভিযুক্তদের তালিকায় কেউ বাদ ছিলেন না। দুর্নীতির অভিযোগে একাধিক বড় বড় নাম গ্রেফতারির খাতায় উঠেছে। মেডিক্যাল পরীক্ষায় ইনদওরের অরবিন্দ হাসপাতালের মুখ্য পরিচালনা আধিকারিকের পুত্রের র‌্যাঙ্ক হয়েছিল ১২। দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতার হয়েছিলেন এমজিএম কলেজের এমবিবিএস ছাত্র মোহিত চৌধরিও।

১৯ ২৫

২০১৩ সালে ব্যাপম দুর্নীতির তদন্তের জন্য মধ্যপ্রদেশ সরকার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠন করে। ২০১৫ সালে এই মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। দীর্ঘ তদন্ত প্রক্রিয়ায় একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তকে প্রভাবিত করা, সাক্ষী বা অভিযোগকারীকে ভয় দেখানো এমনকি মেরে ফেলার অভিযোগও উঠেছে।

২০ ২৫

ইনদওরের চিকিৎসক আনন্দ রাই ব্যাপম দুর্নীতি বিষয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। তা থেকেই তদন্ত শুরু হয়। অভিযোগ, নিয়মিত হুমকি ফোন পেতেন তিনি। তাঁকে খুন করার জন্য ‘সুপারি কিলার’ ভাড়া করা হয়েছিল। আদালতের কাছে নিরাপত্তা চেয়েও তিনি পাননি। পরে ইনদওর থেকে দূরে একটি গ্রামে তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়। মধ্যপ্রদেশ সরকার এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের বিরুদ্ধে বার বার সরব হয়েছেন এই প্রাক্তন বিজেপি কর্মী এবং আরএসএস সমর্থক।

২১ ২৫

মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন রাজ্যপাল রামনরেশ যাদবের নামও জড়িয়েছিল ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে। এসটিএফ রামনরেশের বিরুদ্ধে বনবিভাগে নিয়োগ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছিল। আদালতে তা দাখিল করলে রাজ্যপাল জানান, সংবিধান দ্বারা তিনি সুরক্ষিত। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা যাবে না। হাই কোর্ট তাতে সায়ও দেয়, তবে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি। ২০১৬ সালে অবসরের পর তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ওঠে।

২২ ২৫

রাজ্যপালের পুত্র শৈলেশ যাদব ব্যাপমের চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে রহস্যজনক ভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ব্যাপমের সঙ্গে জড়িত ২৩ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা আদালতে জানিয়েছিল এসটিএফ। কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

২৩ ২৫

ব্যাপমের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছিল পথদুর্ঘটনায়। অভিযোগ, প্রমাণ লোপাটের জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁদের গাড়ি চাপা দিয়ে মারা হয়েছিল। তবে কোনও অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি।

২৪ ২৫

২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ব্যাপম-কাণ্ডে ৮৩ পৃষ্ঠার রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। মোট ৬৩৪ জন চিকিৎসকের ডিগ্রি বাতিল করে দেওয়া হয়। রায়ের কপিতে শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল, ‘‘যদি আমরা নীতি এবং চরিত্রের ভিত্তিতে একটি দেশ গড়তে চাই, সে দেশে যদি আইনের শাসন বজায় রাখতে চাই, তবে কাউকেই ছাড় দেওয়া যাবে না।’’ অভিযুক্ত চিকিৎসকেরা বিনামূল্যে কয়েক বছর চিকিৎসা এবং সমাজসেবার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ডিগ্রি বাতিল আটকাতে চেয়েছিলেন। শীর্ষ আদালতে তা গ্রাহ্য হয়নি।

২৫ ২৫

একাধিক হিন্দি ছবি এবং ওয়েব সিরিজ়ে মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম দুর্নীতির ছায়া দেখা গিয়েছে। এই কেলেঙ্কারির উপর ভিত্তি করেও ছবি তৈরি হয়েছে। তবে ব্যাপম দুর্নীতির তদন্তের শিখরে পৌঁছোনো যায়নি বলেই দাবি করেন অনেকে। যখনই তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তখনই কোনও না কোনও অভিযুক্তের মৃত্যু হয়েছে। অতীতের গর্ভে চাপা পড়ে গিয়েছে সত্য। দেশের সবচেয়ে আলোচিত এবং সবচেয়ে বড় দুর্নীতির মধ্যে অন্যতম হয়ে আছে ব্যাপম।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement