রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে কার প্রাণ যায়? একটুও না ভেবে সবাই জবাব দেবেন, উলুখাগড়ার। কিন্তু যদি উত্তর হয়, শহরের! হ্যাঁ, দুই ক্ষমতাশালীর লড়াইয়ে ‘প্রাণ’ গিয়েছিল একটি আস্ত শহরের। যে সে শহর নয়, একদা বিশ্বের সবচেয়ে চকমকে সেই শহরের নাম ভারোশা। ১৯৭৪ সালের পর সময় এগোয়নি যেখানে।
ভূমধ্যসাগরের পূর্ব প্রান্তের দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য এই দেশ। যদিও তাতেও রয়েছে টুইস্ট। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসকে আড়াআড়ি ভাগ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের বাফার জ়োন। তার এক দিকে তুরস্কের দখলে থাকা উত্তর সাইপ্রাস (টার্কিস রিপাবলিক অফ নর্দার্ন সাইপ্রাস বা টিআরএনসি)। অন্য প্রান্তে সাইপ্রাস। একমাত্র সাইপ্রাসকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক স্তরে।
উত্তর সাইপ্রাসেরই পূর্ব দিকে ছবির মতো সুন্দর ফামাগুস্তা শহর। সেই শহরেরই শহরতলি হিসাবে পরিচিত ছিল ভারোশা। যা একটা সময় ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা সমুদ্র পর্যটন ক্ষেত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। কিন্তু ১৯৭৪ সালে আচমকাই যাত্রা শেষ হয়ে যায় ভারোশার। ৪৯ বসন্ত পেরিয়ে সে দিনের সুন্দরী ভারোশা এখন স্রেফ ‘ভূতের শহর’।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দখলদারির ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতিগুলির প্রায় সব ক’টির নজর ছিল ফামাগুস্তা সংলগ্ন গভীর সমুদ্রের উপর। তুরস্ক আরও এক কদম এগিয়ে ১৯৭৪ সালে গোটা এলাকা দখলে নিয়ে নেয়। তুমুল বোমাবর্ষণ করা হয় ভারোশার উপর। অধিবাসীরা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান অন্যত্র। সেই শেষ, তার পর থেকে আর মানুষের পা পড়েনি ‘ভূতুড়ে’ শহরটিতে।
বর্তমানে তুরস্কের সামরিক বাহিনী এলাকা দখলে রেখেছে। তবে সেখানে রাষ্ট্রপুঞ্জের বাহিনীও মোতায়েন রয়েছে। ১৯৭৪ সালে গ্রিস অধিকৃত সাইপ্রাসের এই অংশের দখল নিয়ে নেয় তুরস্কের সেনাবাহিনী। তার পর থেকে সময় থেমে গিয়েছে বিশ্বের এই প্রান্তে।
ভারোশায় সাধারণ মানুষের ঢোকা বারণ। কেবলমাত্র তুরস্কের সামরিক বাহিনী এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের বাছাই করা প্রতিনিধি এই অঞ্চলে ঢোকার ছাড়পত্র পেতে পারেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে মনোভাবেরও। ইদানীং পশ্চিমি বিশ্বের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক এই এলাকায় ঢুকতে পেরেছেন।
২০২১ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইপ এর্দোয়ান ঘোষণা করেন, পাইলট প্রকল্প হিসাবে ভারোশার সাড়ে তিন শতাংশ জমিকে জনতার জন্য খুলে দেওয়া হবে। যাতে ভারোশার কিছু অংশে হলেও স্বাভাবিক বসবাস আরম্ভ করানো যায়। পরিস্থিতি যে কতটা ‘স্বাভাবিক’ তা বোঝাতে ফটোশিকারিদেরও ভারোশায় ঢোকার ছাড়পত্র দেওয়ার কথাও ঘোষণা করে আঙ্কারা।
টয়োটা থেকে হেব্রনের কাচ— ১৯৭৪ সালের সেই ভয়াবহ ঘটনার আগে ভারোশা শহর কিন্তু ছিল আর পাঁচটা ঝাঁ চকচকে শহরেরই হুবহু কার্বন কপি। চওড়া রাস্তা, দু’পাশে বহুতলের সারি, বার, পাব, রংবেরঙের দোকান— এই ছিল ভারোশার নগরজীবন।
বিশ্বের ইতিহাসে যুদ্ধের জেরে শহর উজাড় হয়ে যাওয়ার কাহিনি কম নেই। ধ্বংস হওয়া শহর আবার নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর গল্পও শোনা যায়। কিন্তু এক বার উচ্ছেদ হওয়ার পর স্রেফ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকার ইতিহাস গোটা বিশ্বে খুব কমই আছে। তারই জ্বলন্ত নিদর্শন ভারোশা।
খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। বহু দূরে চোখ রাখলেও নজরে আসে না এক জনও। কেয়ারি করা বাগানে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। কোনও বাড়ির ব্যালকনিতে এখনও রাখা বিকেলের চায়ের কাপ। কেউ যেন এক চুমুক খেয়ে ভিতরে ঢুকেছেন, একটু পরেই আবার এসে বসবেন। কোনও সুপার মার্কেটে এখনও খোলা দরজা। ক্রেতাদের অপেক্ষায় যেন ঠায় বসে।
একদা ব্যস্ত এই পর্যটন শহরতলির রাস্তা মোড়া ছিল কংক্রিটের মোটা চাদরে। কিন্তু ব্যবহারের অভাবে রাস্তা ফুঁড়ে বেরিয়েছে জংলা গাছ, লতা। চারদিকে অব্যবহারের ছাপ যেন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর। দোকানের সামনে যে সাইনবোর্ড হদিস দিত সম্ভারের, তা আজ ভাঙাচোরা। কোনও রকমে দেওয়ালের গা থেকে তা ঝুলছে। পরিত্যক্ত শহর আজ যেন প্রকৃত অর্থেই ‘ভূতের ডেরা’।
একটি আবাসন চত্বরে গিয়ে দেখা যাবে, পরিপাটি অযত্নের ছাপ। যেন এত দিন কোনও মানুষ তো দূরস্থান, কেবল ধুলোবালির ছোঁয়াই পেয়ে এসেছে। আবাসন চত্বরের কমিউনিটি হল আজ জঙ্গলে ঢাকা পড়েছে। তবে মাঝেমাঝেই উঁকি মেরে যায় পথ নির্দেশিকার সেই রঙিন দণ্ডগুলি। দীর্ঘ দিন পেরিয়ে গিয়েছে, তবুও একদা আভিজাত্যের চিহ্ন কিন্তু অমলিন।
ইদানীং ভারোশায় সংবাদমাধ্যমের আনাগোনা কিছুটা হলেও বেড়েছে। যদিও স্বাধীন ভাবে তাঁদের ঘোরাঘুরির উপায় প্রায় নেই। কারণ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বাইনোকুলার দিয়ে সর্ব ক্ষণ আপনি তুরস্কের সেনার নজরবন্দি। ভারোশায় গাড়ি ঢোকার নিয়ম নেই। ফলে সাইকেল বা বাইকই একমাত্র ভরসা। সেই পরিবহণের ব্যবস্থাও নির্ভর করছে তুরস্কের সেনার মর্জির উপর।
ভারোশার একটি অন্যতম দিক ছিল, তার কাচের ব্যবহার এবং অনন্য শহুরে ভাস্কর্য। কালের নিয়মে শহরতলির কোনও জানলারই কাচ আর অবশিষ্ট নেই। কোথাও আধভাঙা অবস্থা। কিন্তু একটু ভাল করে নজর করলেই বোঝা যায়, একদা এই কাচের প্রলেপ আলো ছড়াত মানুষের মনে।
নিত্য উৎসবে মাতোয়ারা ভারোশায় একদা বাস ছিল গ্রিসের মানুষের। তুরস্ক আক্রমণ করার পরেই তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে পালান চারদিকে। এর্দোয়ানের ঘোষণা যদি সত্যিই বাস্তবে প্রতিফলিত হয়, তা হলে ঘরছাড়া সেই পরিবারগুলি কি আবার ভারোশায় এসে থাকতে পারবেন? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এতটাও আশাবাদী নন। ‘ভূতের শহরে’ আবার কলি ফেরার আশা তাঁরাও যে আর করেন না!