রাজস্থানের নাম শুনলেই মনে আসে হলুদ পাথরে মোড়া ‘সোনার কেল্লা’র জয়সলমেরের কথা। এই শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে এমন এক গ্রাম, যা তার ইতিহাসের জন্য বার বার উঠে আসে শিরোনামে।
জয়সলমেরের অদূরে পরিত্যক্ত গ্রাম কুলধারা। এক সময়ে এই গ্রামেই ছিল রাজস্থানের পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের বাস। ইতিহাস বলছে, উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে গ্রামটি পরিত্যক্ত। কেউ এই গ্রামে আর থাকেন না।
এক সময়ে যে পরিত্যক্ত এই গ্রামেও মানুষের বসতি ছিল, তা গ্রামে পা রাখলেই বোঝা যায়। কুলধারার আনাচেকানাচে বসতির ছাপ লেগে আছে এখনও। মরুভূমির বুকে জীর্ণ বাড়িঘর, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট নিয়ে যেন কাদের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে কুলধারা।
প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, কুলধারায় বসবাসকারী পালিওয়াল ব্রাহ্মণেরা উনিশ শতকের গোড়ায় শাসক সেলিম সিংহের অত্যাচারে গ্রাম ত্যাগ করেন। অভিযোগ, গ্রামের প্রধানের কন্যার উপর সেলিমের কুনজর পড়েছিল। তিনি জোর করে ওই তরুণীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।
সেলিম ঘোষণা করে দেন, নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রধানের কন্যাকে তাঁর হাতে তুলে দিতে হবে। না হলে ফল ভাল হবে না। গ্রামে লুটপাট এবং অত্যাচার চালানোর হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন সেলিম।
কুলধারা প্রদেশের মোট ৮৫টি গ্রামের পালিওয়াল ব্রাহ্মণ পরিবার সেলিমের এই ঘোষণার পর একজোট হয়। তাঁরা কিছুতেই প্রধানের কন্যাকে অত্যাচারী শাসকের হাতে তুলে দিতে রাজি হননি। অথচ, শাসকের রোষের মুখেও পড়তে চাননি কেউ। ফলে অন্য উপায় খুঁজে নেয় কুলধারা।
এক রাতে প্রধানের কন্যাকে নিয়ে শাসকের চোখে ধুলো দিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যান কুলধারার মানুষ। যে যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থাতেই গ্রাম ছাড়েন। সকলে একসঙ্গে এক রাতে যেন স্রেফ উবে গিয়েছিলেন। এত মানুষ কোথায় গেলেন, আর কখনও তা জানা যায়নি। কুলধারায় এই পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের আর কোনও খোঁজ পায়নি ইতিহাস।
কথিত আছে, নিরুপায় হয়ে গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে অত্যাচারী সেলিম এবং গোটা গ্রামের উপরেই অভিশাপ দিয়ে যান গ্রামবাসীরা। তাঁদের অভিশাপের কারণে আর কেউ কখনও ওই গ্রামে থাকতে পারেননি। গ্রামটি সেই থেকে পেয়েছে ‘ভূতুড়ে’ তকমা।
অনেকে বলেন, কুলধারায় যাঁরাই নতুন করে বসতি গড়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁরাই ‘ভূতের’ কবলে পড়েছেন। ওই পরিত্যক্ত গ্রামে রাত কাটাতে গেলেই নাকি অদ্ভুত এবং অশরীরী উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আজও যেন কুলধারার অলিগলিতে পালিওয়ালরাই বাস করেন। বসতভিটের মায়া ছাড়তে পারেননি তাঁরা।
২০১০ সালে ইন্ডিয়ান প্যারানর্মাল সোসাইটি থেকে কুলধারায় যান গৌরব তিওয়ারি এবং তাঁর দলবল। তাঁরা ওই পরিত্যক্ত গ্রামে রাত কাটিয়েছিলেন। তাঁদের দাবি, রাতে তাঁরা ছায়ামানবদের চলাফেরা করতে দেখেছেন। কিছু অশরীরী গলার স্বর শুনতে পেয়েছেন। কেউ কেউ নিচু স্বরে কথা বলছিলেন বলেও দাবি।
জয়সলমেরের উপকণ্ঠে এই আপাত-অখ্যাত গ্রামে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এই ‘ভূতের’ কাহিনি। কুলধারার আশপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা অবশ্য ভূতুড়ে কোনও ঘটনার কথা কখনও স্বীকার করেননি। তাঁদের কেউ প্রাচীন কাহিনিতে বিশ্বাস করেন, কেউ আবার করেন না।
ইতিহাসবিদ এবং গবেষকেরা জানাচ্ছেন, উনিশ শতকে থর মরুভূমির বুকে কুলধারা গ্রামটি খালি হয়ে যাওয়ার অন্যতম মূল কারণ হতে পারে প্রবল জলসঙ্কট। গ্রামের কুয়ো এবং জলাধারগুলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে গিয়েছিল। তাই গ্রামটিতে আর কেউ থাকতে পারেননি।
পরিসংখ্যান বলছে, সতেরো কিংবা আঠেরো শতকে কুলধারার জনসংখ্যা ছিল ১৫৮৮। ১৮১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮০০-তে। ১৮৯০ সালে দেখা যায় কুলধারায় রয়েছেন মাত্র ৩৭ জন গ্রামবাসী। ধীরে ধীরে তাঁরাও গ্রাম ছাড়েন। কোনও এক বিশেষ রাতে গ্রাম ছেড়ে একযোগে সকলের অন্তর্ধানের কথা ইতিহাসে বলা নেই।
কুলধারা খালি হয়ে যাওয়ার একটি কারণ হিসাবে অবশ্যই উঠে আসে সেলিম সিংহের নাম। তিনি অত্যাচারী ছিলেন। পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের উপর তিনি বহু কর আরোপ করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, সেই কারণেই গ্রামে টিকতে পারেননি কেউ।
২০১৭ সালে ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, কুলধারা ছেড়ে গ্রামবাসীদের অন্তর্ধানের অন্যতম কারণ সম্ভবত ভূমিকম্প। কুলধারার বাড়িঘর এখন যে অবস্থায় পাওয়া যায়, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সেই ক্ষয়ক্ষতি সম্ভব নয়। ভূমিকম্পের ফলে বড়সড় ধাক্কা খেয়ে ঘরবাড়িগুলি ভেঙে পড়েছিল বলে দাবি গবেষকদের একাংশের।
কিন্তু ভূমিকম্পের ধাক্কায় বাড়ি ভেঙে পড়লেও গ্রামের মানুষেরা গেলেন কোথায়? কেন কুলধারার পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের আর কোনও খোঁজ কখনও মিলল না? কোন অদৃশ্য জাদুবলে তাঁরা গায়েব হয়ে গেলেন? এ সব প্রশ্ন আজও উঁকি মারে কুলধারার ভাঙাচোরা বাড়িঘরের আনাচেকানাচে। যার উত্তর কেউ জানেন না।