বলিউডে প্রথম সারির গায়িকা হিসাবে পরিচিতি গড়ে তুলেছেন সুনিধি চৌহান। চড়া সুর থেকে ধাপে ধাপে নেমে নিচু সুরে গান বাঁধতেও সমান পারদর্শী তিনি। সম্প্রতি আমেরিকার গায়িকা টেলর সুইফ্টের সঙ্গে তুলনা করে হচ্ছে তাঁকে। পারফর্ম্যান্সের দিক দিয়ে এখন সুনিধির জু়ড়ি মেলা ভার বলে দাবি দর্শক এবং শ্রোতাদের।
টেলর সুইফ্ট তাঁর কনসার্ট চলাকালীন মঞ্চে যেমন পারফর্ম করেন, সুনিধিও যেন তাঁর মতোই পারফর্ম করছেন। গানের পাশাপাশি সেই তালে-ছন্দে নাচের মাধ্যমেও মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন তিনি। অথচ এক সময় কণ্ঠস্বরের কারণেই কাজ পাননি সুনিধি। গায়িকার কণ্ঠে পুরুষালি ভাব লক্ষ্য করেছিলেন বলে নাকি গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি তাঁকে।
১৯৮৩ সালের ১৪ অগস্ট নয়াদিল্লিতে জন্ম সুনিধির। পাঁচ বছর বয়স থেকেই গানবাজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। পাড়ায় কোনও গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেই ডাক পড়ত সুনিধির।
১৩ বছর বয়সে হিন্দি ছবিতে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ পান সুনিধি। ১৯৯৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শাস্ত্র’ ছবিতে গান গেয়েছিলেন কিশোরী সুনিধি।
তার পর গানের একটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন সুনিধি। সেখান থেকে আরও একটি হিন্দি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান তিনি। রামগোপাল বর্মার পরিচালনায় ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মস্ত’ ছবিতে গান গেয়ে পরিচিতি গড়ে তোলেন সুনিধি।
২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ফিজ়া’ ছবিতে ‘মেহবুব মেরে’ গানটি গেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সুনিধি। চার বছর পর ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ধুম’ ছবিতে ‘ধুম মচালে ধুম’ গানটি গাওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি গায়িকাকে।
‘পরিণীতা’, ‘দস’, ‘চামেলি’, ‘ওমকারা’, ‘অকসর’, ‘৩৬ চায়না টাউন’, ‘আজা নাচলে’, ‘লভ আজ কাল’, ‘রব নে বানা দি জোড়ি’, ‘খাকী’, ‘ধুম ২’, ‘ফনা’, ‘শিবায়’-এর মতো হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন সুনিধি।
গানের পাশাপাশি বড় পর্দায় অভিনয় করতেও দেখা গিয়েছে সুনিধিকে। ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এহেসাস: দ্য ফিলিং’ ছবিতে ক্যামিয়ো চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এই ছবির মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন সুনীল শেট্টি এবং নেহা বাজপেয়ী। ‘প্লেয়িং প্রিয়া’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি।
একাধিক হিন্দি ছবিতে গানের দৃশ্যে অভিনয় করেন সুনিধি। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সন্স অফ রাম’ নামে অ্যানিমেটেড ঘরানার ছবিতে সীতার চরিত্রে কণ্ঠ দেন গায়িকা। ‘রিয়ো’ ছবিতে জুয়েলের চরিত্রেও কণ্ঠ দেন তিনি। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘রক অন ২’ ছবিতে গানের রিয়্যালিটি শোয়ের বিচারকের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে।
বাস্তবেও গানের একাধিক রিয়্যালিটি শোয়ে বিচারকের আসনে দেখা গিয়েছে সুনিধিকে। হিন্দি ছবির পাশাপাশি মরাঠি, তামিল, তেলুগু, পঞ্জাবি, কন্নড় এবং পাকিস্তানি ছবিতেও গান গেয়েছেন তিনি।
সুনিধির বাবা থিয়েটারে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা-মা এবং বোনের সঙ্গে নয়াদিল্লিতে থাকতেন সুনিধি। সেখানেই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন তিনি।
সুনিধির বাবাই সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন। কানাঘুষো শোনা যায়, কন্যা যেন সঙ্গীত নিয়ে কেরিয়ার তৈরি করতে পারেন সে কারণে চাকরি ছেড়ে দিল্লি থেকে মুম্বই চলে যান সুনিধির বাবা।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কখনই প্রতিষ্ঠানগত প্রশিক্ষণ নেননি সুনিধি। রেডিয়ো এবং ক্যাসেটে গান শুনেই গান তুলতেন তিনি। ১১ বছর বয়স থেকে ইংরেজি গান গাওয়াও রপ্ত করে ফেলেন তিনি।
১৩ বছর বয়সে প্রথম মিউজ়িক অ্যালবাম মুক্তি পাওয়ার পর গানের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন সুনিধি। কেরিয়ার শুরুর প্রথম দু’বছর ‘ব্যাকগ্রাউন্ড ভোকালিস্ট’ হিসাবে গান করেন তিনি।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, এক একটি গান করতে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক পান সুনিধি। ২০০২ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সঙ্গীতনির্মাতা ববি খানের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন গায়িকা।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, ‘পহেলা নশা’ নামের একটি মিউজ়িক ভিডিয়োর সূত্রে ববির সঙ্গে আলাপ হয় সুনিধির। কিন্তু বিয়ের পর তাঁদের সম্পর্ক এক বছরও টেকেনি। ২০০৩ সালে বিবাহবিচ্ছেদের পথে হাঁটেন দুই তারকা।
কানাঘুষো শোনা যায়, ববির সঙ্গে সুনিধির বিয়ে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন সুনিধির বাবা-মা। এমনকি, ববিকে বিয়ে করলে সুনিধির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না এমনও জানিয়েছিলেন তাঁরা।
পরিবারের বারণ সত্ত্বেও ববিকে বিয়ে করেন সুনিধি। মতের অমিল হওয়ায় মাঝেমধ্যেই অশান্তি হত সুনিধি এবং ববির। কানাঘুষো শোনা যায়, তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরার পর ববির সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকতেনও না গায়িকা।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, ববির সঙ্গে সম্পর্কে ফাটলের পর বলি অভিনেতা অন্নু কপূর এবং তাঁর স্ত্রী অরুণিতা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন সুনিধি। বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে এক পুরনো সাক্ষাৎকারে সুনিধি জানিয়েছিলেন, প্রথম বিয়েকে নিজের জীবনের ‘বড় ভুল’ হিসাবে দেখেন গায়িকা।
সুনিধি বলেছিলেন, ‘‘আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। কিন্তু আমি সেই ভুলগুলির প্রতি কৃতজ্ঞ। এত কম বয়সে আমার উপর এত ঝড় বয়ে গিয়েছে সেই জন্য কিন্তু ভগবানকে আমি প্রতি মুহূর্তে ধন্যবাদ জানাই।’’
সুনিধির দাবি, জীবনে ভুল করেছেন বলেই বর্তমানে সফল হতে পেরেছেন তিনি। গায়িকা বলেছিলেন, ‘‘আমি যে জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম তা নিয়ে অবগত ছিলাম। আমি জানতাম যে আমি ভুল জায়গায় রয়েছি। কিন্তু তার পাশাপাশি এ-ও জানতাম যে এমন অবস্থায় বেশি দিন থাকব না আমি। ঠিক বেরিয়ে আসব। সেই ভরসাটা ছিল।’’
বিচ্ছেদ নিয়ে সুনিধি আরও বলেছিলেন, ‘‘সময় পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে এগিয়ে যেতে না পারলে হবে না। আমার বাবা-মা সব সময় আমার পাশে ছিলেন। আমি জীবনের সমস্যাগুলিকে অন্য নজরে দেখি। সকলের জীবনেই কঠিন সময় আসে। সকলেই ভেঙে পড়ে। তা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বেশি দিন সে ভাবে থাকা যায় না। নিজের হাত ধরে নিজেকেই টেনে তুলতে হয়। নিজের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হতে হয়।’’
ববির সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সঙ্গীতনির্মাতা হিতেশ সোনিকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান সুনিধি। তাঁরা দু’জনে ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন। সেই বন্ধুত্বই পরে প্রেমে পরিণত হয়। দু’বছর সম্পর্কে থাকার পর ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল হিতেশের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন সুনিধি।
বিয়ের পর ২০ কিলোগ্রাম ওজন বৃদ্ধি পেয়ে যায় সুনিধির। মঞ্চে পারফর্ম করতে অসুবিধা হবে বুঝে ডায়েটের পাশাপাশি শরীরচর্চা করতে শুরু করেন গায়িকা। রাতারাতি ১২ কিলোগ্রাম ওজন কমিয়ে ফেলেন তিনি।
হিতেশের সঙ্গে বিয়ের ছ’বছর পর পুত্রসন্তানের জন্ম দেন সুনিধি। বলিপাড়ায় কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল, হিতেশের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরেছে সুনিধির। কিন্তু সে সব ভুয়ো খবর বলে জানিয়েছিলেন গায়িকা নিজেই।
এক পুরনো সাক্ষাৎকারে সুনিধি জানিয়েছিলেন, বলিপাড়ার বহু সঙ্গীতনির্মাতা তাঁকে শুধুমাত্র আইটেম সং গাওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। তাঁর স্বর যে পুরুষালি সেই মন্তব্যও করেছেন অনেকে।
২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অজনবি’ ছবির ‘মেরি জিন্দেগি মে’ গানে কুমার শানুর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন সুনিধি। গায়িকা জানান, বলিপাড়ার খ্যাতনামী সঙ্গীতশিল্পী অনু মালিক তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সুনিধি যে নরম সুরতালের গানও গাইতে পারেন তা জানিয়েছিলেন অনুই। তার পর থেকেই সুনিধি রোম্যান্টিক ঘরানার গান গাওয়ার অনুরোধ পেতে শুরু করেন বলে দাবি করেছিলেন গায়িকা।
পুরুষালি স্বর হওয়ার জন্য অনেক রকম গান গাওয়ার সুযোগ পেতেন না সুনিধি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘‘কেউ মিহি গলায় গান করেন, কেউ আবার ভারী গলায়। তার মাঝামাঝি কেউ সুর বাঁধলে তাকে কী বলা হয় তা জানেন না অনেকেই। তাই হয়তো পুরুষালি স্বরের অধিকারিণী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে আমায়। তবে আমি তা প্রশংসা হিসাবেই নিয়েছি।’’
গানের পাশাপাশি সমাজসেবার সঙ্গেও যুক্ত সুনিধি। কোনও কোনও অনুষ্ঠানের উপার্জনের টাকা সমস্তই সমাজসেবার জন্য দান করে দেন তিনি। সমাজমাধ্যমেও তাঁর অনুরাগী মহল নজরে পড়ার মতো। ইতিমধ্যেই ইনস্টাগ্রামে সুনিধির অনুরাগী সংখ্যা ২১ লক্ষের গণ্ডি পার করে ফেলেছে। বর্তমানে কেরিয়ার এবং সংসার নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে সুনিধির জীবন।