আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস অববাহিকা থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফার্নান্দো উপত্যকা সড়কপথে যুক্ত করে কাহুয়েঙ্গা পাস। এই পাসের স্পেনীয় নাম পাসেও দে কাহেয়ুঙ্গা। সারা দিন এই পাসের উপর দিয়ে গাড়ির যাতায়াত চলে। কিন্তু এই কাহুয়েঙ্গা পাসের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ধনদৌলতের অভিশপ্ত ইতিহাস।
লোকমুখে শোনা যায়, কাহুয়েঙ্গা পাসের নিকটবর্তী এলাকায় ধনসম্পত্তির খোঁজে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েন অনেকে। এমনকি কী কারণে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে সে রহস্যের সমাধান হয়নি কখনওই।
ঘটনার শুরু ১৮৬৪ সালে। অস্ট্রিয়ার অধিবাসী ম্যাক্সিমিলিয়ন এবং তাঁর স্ত্রী কার্লোটা সেই সময় মেক্সিকো শাসন করছেন। কিন্তু তাঁদের শাসন বেশি দিন চলেনি। তিন বছর পর বেনিটো জুয়ারেজের হাতে মারা যান ম্যাক্সিমিলিয়ন। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট পদে বসেন বেনিটো।
ম্যাক্সিমিলিয়নের মৃত্যুর পর যাবতীয় রাজসম্পত্তি নিজের বিশ্বস্ত চার জন সেনার মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বেনিটো।
রাজসম্পত্তি বিক্রি করে তা দিয়ে বন্দুক কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেনিটো। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা যায়, দু’লক্ষ ডলার মূল্যের সোনা, হিরে, পান্না-সহ রাজপরিবারের যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ে মেক্সিকো থেকে রওনা দিয়েছিলেন চার জন সেনা।
বে এরিয়া পর্যন্ত যাওয়ার পর চার জন সেনা লক্ষ করেন যে সেখানে ফ্রান্সের গুপ্তচরেরা ঘোরাঘুরি করছেন। ফ্রান্সের সঙ্গে সে সময়ে বেনিটোর সম্পর্ক ভাল ছিল না। তাঁদের চোখে ধুলো দিয়ে কোনও ভাবেই বিপুল পরিমাণ ধনসম্পত্তি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে অন্য পথ ধরেন বেনিটোর সেনারা।
কোনও উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হরিণের চামড়ায় সমস্ত ধনরত্ন মুড়ে রাখতে শুরু করেন বেনিটোর চার সেনা। তার পর চামড়ায় মোড়ানো ধনসম্পত্তি মাটিতে পুঁতে সেখান থেকে পালিয়ে যান।
তাঁরা যে গোটা প্রক্রিয়া লোকচক্ষুর আড়ালেই করেছেন, এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন বেনিটোর চার সেনা। কিন্তু তাঁদের এই গোপন কাজ নজরে পড়ে যায় দিয়েগো মোরেনো নামে এক ব্যক্তির। পেশায় পশুপালক ছিলেন তিনি।
প্রচুর পরিমাণ ধনসম্পত্তির লোভ সামলাতে পারেননি দিয়েগো। ঘটনাস্থল থেকে সেনারা চলে যাওয়ার পর মাটি খুঁড়ে সমস্ত গুপ্তধন বার করে আনেন দিয়েগো। বিত্তশালী হওয়ার স্বপ্ন চোখে নিয়ে মেক্সিকোয় বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন তিনি। কাহুয়েঙ্গা পাস থেকে দক্ষিণের দিকে যাত্রা শুরু করেন দিয়েগো। লস অ্যাঞ্জেলস অতিক্রম করে বাড়ি যেতে হত তাঁকে।
কয়েক ঘণ্টা পর মাটিতে পুঁতে রাখা সম্পদ ফেরত আনতে পৌঁছন বেনিটোর সেনারা। কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর পর কোথাও কিছু খুঁজে না পেয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন যে সর্বস্ব চুরি গিয়েছে। কিন্তু কে চুরি করল? কেউ তো তাঁদের দেখেননি! একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকেন তাঁরা। ভুল বোঝাবুঝি থেকে শুরু হয় তুমুল লড়াই। আক্রোশে একে অপরকে খুনও করে ফেলেন সেনারা।
অন্য দিকে সম্পত্তি নিয়ে কাহুয়েঙ্গা পাস অতিক্রম করে লা নোপারেলা নামে একটি জায়গায় পৌঁছন দিয়েগো। কিছু ক্ষণ সেখানে বিশ্রাম নেবেন বলে ঠিক করেন তিনি। বিশ্রাম নিতে গিয়ে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন দিয়েগো। স্বপ্নে দেখেন, এই সম্পদ নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলসে প্রবেশ করলেই তাঁর মৃত্যু অবধারিত। ভয়ে ঘুম ভেঙে যায় দিয়েগোর।
স্বপ্নে দৈববাণী পেয়েছেন ভেবে আর গুপ্তধন নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন না দিয়েগো। একটি গাছের তলায় সমস্ত ধনসম্পত্তি পুঁতে ফেলেন তিনি। তার পর লস অ্যাঞ্জেলসের পথে যাত্রা শুরু করেন দিয়েগো।
লস অ্যাঞ্জেলস যাওয়ার পথে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন দিয়েগো। পথে তাঁর বন্ধু মার্টিনেজের বাড়ি ছিল। অসুস্থ দিয়েগোকে আশ্রয় দেন মার্টিনেজ। তাঁকে আশ্রয় দেওয়ায় উপহার হিসাবে বন্ধুকে ধনসম্পত্তির পুরোটাই দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন দিয়েগো। কোথায় সেই গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছেন তার ঠিকানাও মার্টিনেজকে বলে দেন। সেই রাতেই রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় তাঁর।
দিয়েগোর মৃত্যুর পর সম্পত্তির সন্ধানে সৎপুত্রকে নিয়ে লা নোপারেলায় পৌঁছন মার্টিনেজ। কিন্তু মাটি খোঁড়া শুরু করতেই হঠাৎ হাত-পা অবশ হয়ে যায় তাঁর। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রহস্যজনক ভাবে মারা যান তিনি।
মার্টিনেজের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখার পর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান তাঁর সৎপুত্র। গুপ্তধনের পরিমাণ বিপুল হলেও তার সঙ্গে যে ভয়ানক অভিশাপ জড়িয়ে রয়েছে তা ধরে নেন তিনি। পরে আর সেই সম্পত্তির ধারেকাছেও যাননি মার্টিনেজের সৎপুত্র।
মার্টিনেজের মৃত্যুর পর কেটে যায় প্রায় ২০ বছর। ১৮৮৫ সালের ঘটনা। স্পেনের এক মেষপালক তাঁর কুকুরের সঙ্গে সেই গাছের তলায় বসেছিলেন। সেখানকার মাটি খুঁড়ছিল পালকের কুকুরটি। মাটি খুঁড়তেই হঠাৎ একটি বহুমূল্য মুদ্রা বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
বহুমূল্য মুদ্রা নিয়ে সেখান থেকে সোজা স্পেনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন মেষপালক। স্পেনগামী একটি জাহাজে উঠে পড়েন তিনি। বন্দরে পৌঁছনোর আগে জাহাজের উপরে উঠে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিলেন তিনি। সেই সময়ে জাহাজ থেকে পড়ে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর।
রাজসম্পত্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ‘অভিশাপের’ কথা চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়। মেষপালকের মৃত্যুর প্রায় এক দশক পর গুপ্তধনের সন্ধানে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নেন কোরিয়া নামে এক ব্যক্তি। কিন্তু নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছনোর আগেই ব্যক্তিগত বচসার কারণে শ্যালকের হাতে খুন হন তিনি।
কথিত রয়েছে বছরের পর বছর গুপ্তধনের সন্ধানে সেখানে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা আর প্রাণে বাঁচেননি। গুপ্তধনের সত্যতা যাচাই করতে ‘মেটাল ডিটেক্টর’ নিয়ে কাহুয়েঙ্গা পাসের কাছে গিয়েছিলেন ধনশিকারিরা। কিন্তু যন্ত্রে ধাতুর উপস্থিতি টের পেলেও মাটি খোঁড়ার পর কিছুই পাননি তাঁরা।
হেনরি জোনস নামে এক ব্যক্তি প্রায় এক মাস ধরে কাহুয়েঙ্গা পাসের কাছে গুপ্তধনের সন্ধান চালান। ঘটনাচক্রে সেই সময় বিবাহবিচ্ছেদ হয় হেনরির। কোনও মূল্যবান রত্নের খোঁজ পাচ্ছিলেন না বলে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি পেশাগত জীবনেও ব্যর্থ হয়ে পড়ায় আত্নহত্যার পথ বেছে নেন হেনরি।
কাহুয়েঙ্গা পাসের কাছে আদৌ কোনও গুপ্তধন রয়েছে কি না অথবা এর সঙ্গে কোনও ‘অভিশাপ’ জড়িয়ে রয়েছে কি না তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে একের পর এক রহস্যজনক মৃত্যুর নেপথ্যে যে ভয়ানক কোনও ‘অভিশাপ’ রয়েছে তা উড়িয়ে দেন না সেখানকার স্থানীয়েরা।